প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস

ঘর সাজানোও শিল্প। গৃহসজ্জার মধ্যেই প্রকাশ পায় রুচিবোধ। নিজের ফ্ল্যাট হোক আর ভাড়া বাসা, গৃহসজ্জার সঙ্গে যদি প্রকৃতিকে জুড়ে দেওয়া গেলে অন্দরের সৌন্দর্য ও আর প্রকৃতির মেলবন্ধন নিয়ত বোলাবে প্রশান্তির পরশ। আজ ৫ জুন। বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘ইকোসিস্টেমের পুনরুদ্ধার’। আর এটা নিজের ঘর থেকেই শুরু করা সম্ভব। তাই প্রকৃতিনির্ভর গৃহসজ্জা নিয়ে দুকথা বলাই যায়।

খুব সহজেই সবুজের ছোঁয়া মেলে মানি প্ল্যান্টে

ঘরের ভেতরে খুব বেশি জায়গা পাওয়া যায় না; আবার সবার বাড়িতে টেরেসও থাকে না। কিন্তু সবার ঘরেই কিছু না কিছু জায়গা আছে যেখানে ছোট ছোট গাছ লাগিয়ে শোভা বাড়ানো যায়। এমন কিছু অভ্যন্তরীণ উদ্ভিদ আছে, যা ন্যূনতম জায়গা নেয়, এমনকি কম রোদের প্রয়োজন হয়। অভ্যন্তরীণ উদ্ভিদগুলো নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে শুধু সৌন্দর্যেই নয়, বরং স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী এমন উদ্ভিদ নির্ধারণ করলেই ভালো। ঘরের সবুজ প্রকৃতি দেখে আরও স্বাচ্ছন্দ্য এবং মন শান্ত বোধ করতে সহায়তা করে, যা প্রতিদিনের মেজাজকে চাঙা করে। অভ্যন্তরীণ উদ্ভিদের গুণ এবং নান্দনিক দিক জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করবে। মূলত যে উদ্ভিদগুলো কেবল বাতাসকেই সতেজ করে না বরং ক্ষতিকারক টক্সিনগুলোও দূর করে, সেই উদ্ভিদগুলো গৃহসজ্জার জন্য সবচেয়ে ভালো।

অন্দরসজ্জায় উদ্ভিদ কেবল শোভা বাড়া নয়, পরিবেশ সুরক্ষাও করে

২০০৭ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে নাসার বিস্তৃত গবেষণা থেকে জানা গেছে কিছু অভ্যন্তরীণ উদ্ভিদ আছে, যা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৮৭ শতাংশ বায়ুতে টক্সিন অপসারণ করতে পারে। সেই গবেষণায় আরও প্রমাণিত হয়েছে যে অভ্যন্তরীণ উদ্ভিদের ঘনত্ব মানুষের কর্মক্ষমতা ১৫ শতাংশ উন্নতি করে, মানসিক চাপের মাত্রা হ্রাস করে এবং মন–মেজাজকে ঝরঝরে করে তোলে।

প্রকৃতিনির্ভর গৃহসজ্জার সহজ উপায়

অভ্যন্তরীণ উদ্ভিদে খুব বেশি রোদের প্রয়োজন পড়ে না, এমনকি বেশির ভাগ অভ্যন্তরীণ গাছপালা সরাসরি মধ্যাহ্নের রোদ পছন্দ করে না। নতুনভাবে ঘরে সবুজ প্রকৃতি তৈরি করে প্রথমে এমন কিছু উদ্ভিদ নির্বাচন করতে হবে, যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে প্রচুর সবুজ এনে দেবে। এমন একটি উদ্ভিদ হলো মানি প্ল্যান্টস।

ডেভিলস আইভি অক্সিজেনের চলাচল বাড়ায়

ডেভিলস আইভি, সিলভার ভাইন, গোল্ডেন পথোস, হান্টার রোবসহ অনেক নাম থাকলেও মানি প্ল্যান্ট নামেই পরিচিত। সবুজ-হলুদ রঙের শেডের পাতায় ঘরে চমৎকার পরিবেশ তৈরি করে এবং লতানো হওয়ায় গৃহসজ্জায় অন্য মাত্রা এনে দেয়। মাটি ছাড়াও আরেকটি সুবিধা শুধু পানিতেই এই উদ্ভিদ বেড়ে ওঠে। তবে মাঝেমধ্যে পানি বদলে দিতে হয়। মানি প্ল্যান্ট ঘরের বাতাস বিশুদ্ধ রেখে অক্সিজেনের চলাচল বাড়ায়। উজ্জ্বল আলোয় জলদি বেড়ে উঠলেও ঘরের যেখানে সরাসরি সূর্যের আলো আসে নাসেখানে মানি প্ল্যান্ট রাখা যায়। খুব যত্নের লাগে না।

ইংলিশ আইভি বাতাসের ৬০ শতাংশ টক্সিন শেঅষণ করে

দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে ঘরে প্রকৃতির ছোঁয়া আনতে আরেকটি উদ্ভিদ ইংলিশ আইভি। ইংলিশ আইভি ঘরে বা বারান্দায় এমনকি বাথরুমেও লাগানো যায়। শুধু শোভাবর্ধনের পাশাপাশি এই গাছ ঘরে বাতাসের ৬০ শতাংশ টক্সিন এবং ৫৮ শতাংশ দুর্গন্ধ শুষে নিতে পারে মাত্র ৬ ঘণ্টায়। ইংলিশ আইভি শিশুদের নাগালের বাইরে রাখতে হবে, কারণ এর পাতা একটু বিষাক্ত।

রাতের ঘুমের জন্য উদ্ভিদ

গাছপালা দিনে অক্সিজেন দেয় এবং রাতে সালোকসংশ্লেষণ বন্ধ হয়ে গেলে বেশির ভাগ উদ্ভিদই কার্বন ডাই-অক্সাইড ছাড়ে। তবে স্নেক প্ল্যান্ট, অর্কিড, সাকুল্যান্টস বা ব্রোমেলিয়েডের মতো উদ্ভিদগুলো রাতে অক্সিজেন নির্গত করে। এই উদ্ভিদগুলো বেডরুমের জন্য সবচেয়ে ভালো।

স্নেক প্ল্যান্ট রাতে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবংঅক্সিজেন ছাড়ে

স্নেক প্ল্যান্ট রাতে সবচেয়ে ভালো ভূমিকায় থাকে। বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং রাতেই অক্সিজেন ছাড়ে সবচেয়ে বেশি। ভালো ঘুমের জন্য খুব কার্যকরী এই উদ্ভিদ। তাই বেডরুমের জন্য আদর্শ স্নেক প্ল্যান্ট। এ ছাড়া এই উদ্ভিদ এয়ার কন্ডিশন থেকে নির্গত ফরমালডিহাইড দূর করে। খুব বেশি পরিচর্যার প্রয়োজন পড়ে না। রোদ, ছায়া বা পানিশূন্য স্থানে ভালোভাবেই বেড়ে উঠতে পারে স্নেক প্ল্যান্ট। এমনকি সহজে মরেও না।

অর্কিড রাতে অক্সিজেন ছাড়ে

অর্কিড রাতে অক্সিজেন ছাড়ে। তাই ভালো ঘুমের জন্য বেডরুমের আরেকটি জীবন্ত শোপিস অর্কিড। অর্কিডের ফুল বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে এবং এই ফুল সাধারণত দীর্ঘদিন থাকে। কোনো কোনো অর্কিডের ফুলে মৃদু সুগন্ধও থাকে, যা মেজাজকে আরও চাঙা করে। তবে অর্কিডের বিশেষ কিছু যত্ন নিতে হয়।

দূষিত বাতাস পরিশোধনে উদ্ভিদ

যেসব উদ্ভিদ প্রাকৃতিকভাবে কম আলোতে আলোকসংশ্লেষণ করতে পারে সেগুলো ঘরের অন্দরের জন্য উপযুক্ত। সেই উদ্ভিদগুলোই সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া মাধ্যমেই ঘরের বায়ু পরিশোধন করে।

অ্যালোভেরা ঘরে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়

অ্যালোভেরা গাছ সাদা সিরামিকের পাত্রে ড্রয়িংরুমের শোভা বর্ধনে একটু ভিন্নতার ছোঁয়া দেবে। শুধু সৌন্দর্যেই নয় অ্যালোভেরা গাছ ঘরে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ঘরের মধ্যে থাকা কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, ফরমালডিহাইডের মতো ক্ষতিকারক উপাদান শোষণ করে। একটি গাছই ৯টি বায়োলজিক্যাল এয়ার পিউরিফায়ার মতো বাতাস পরিষ্কার করতে পারে।

পিস লিলি চমৎকার বাতাস পরিশোধক

পিস লিলিগাছ ঘরের যেকোনো জায়গাতেই রাখা যায়। গ্রীষ্মে সাদা ফুল ফোটে। অল্প আলো ও বাতাসেই এই গাছ বেড়ে ওঠে। শুধু বাঁচার জন্য স্বাভাবিক পরিমাণে পানি দিলেই যথেষ্ট। সরাসরি সূর্যের আলোতে না রাখাই ভালো। সরাসরি রোদ পেলেই পাতা হলুদ হয়ে যায়। পিস লিলি চমৎকার বাতাস পরিশোধক। ঘরের ভেতরের বাতাসে থাকা রাসায়নিক আর টক্সিন নিমেষেই শুষে নেয়। বিশেষ করে বেনজিন, ট্রাইক্লোরোইথিলিন, ফরমালডিহাইড, জাইলিন শোষণ করে বাতাস পরিষ্কার করে দেয়।

এরিকা পাম বিষাক্ত গ্যাস ও দূষিত পদার্থ অপসারণ করে

এরিকা পাম ঘরে প্রাণের স্পর্শ দেয়। দেখতে অনেকটা ছোট বেতগাছের মতোই। কেন পাম বা গোল্ডেন ফেদার নামেও পরিচিত এই গাছ। এরিকা পামের উজ্জল সবুজ রঙের ঝিরিঝিরি পাতা চতুর্দিকে ছড়িয়ে গিয়ে ঘরের সৌন্দর্যকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। জানালার পাশে, ফার্নিচারের পাশে বা ঘরের যেকোনো কোণে রাখলে দেখতে খুব সুন্দর লাগে। ঘরের অভ্যন্তরের বিষাক্ত গ্যাস ও দূষিত পদার্থ কে অপসারণ করে ও বাতাসকে বিশুদ্ধ করে খুব সহজেই ঘরের অভ্যন্তরীণ পরিবেশকে ভালো রাখে। ঘরের সামান্য আলোতেই এই গাছ ভালো থাকে। সরাসরি সূর্যের আলোয় এর পাতা হলদে হয়ে যায়। তবে একটু যত্ন নিতে হয় এই গাছের।

ফিকাসগাছ বৃদ্ধির জন্য তুলনামূলক কম আলো ও তাপমাত্রা প্রয়োজন হয়। ফলে ঘরের মধ্যে ভালোভাবে বাঁচে এই গাছ। ফিকাসগাছ ঘরের বাতাস পরিষ্কার করতে পারে খুব ভালো। বিশেষ করে বাতাসের টক্সিন শুষে নিয়ে বিশুদ্ধ বাতাস সরবরাহ করে।

রান্নাঘরের কার্বন মনোক্সাইড পরিশোধনে

স্পাইডার প্ল্যান্ট রাতে অক্সিজেন নিঃসরণ করে

চিকন ছড়ানো পাতার স্পাইডার প্ল্যান্ট বাঁচার জন্য প্রাকৃতিক আলোর প্রয়োজন হলেও সরাসরি সূর্যের আলোর প্রয়োজন পড়ে না। রাতে ঘরের বাতাসে বেশি অক্সিজেন নিঃসরণ করে, তাই রাতে ঘুম ভালো হতে সহায়তা করে। স্পাইডার প্ল্যান্ট দূষিত বাতাস পরিশোধনে সহায়ক। বিশেষ করে রান্নার কারণে ঘরের মধ্যে যে কার্বন মনোক্সাইড থাকে, তা শুষে নিতে পারে। স্পাইডার প্ল্যান্ট রান্নাঘরেও রাখা যায়। তা ছাড়া যেকোনো দুর্গন্ধ দূর করতেও এই উদ্ভিদ বেশ উপযোগী।

পোকামাকড় তাড়াতে

লেমনগ্রাস থাই পাতা নামেও পরিচিত। এটি একটি ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ। দেশের পাহাড়ি এলাকায় চাষ করা হলেও স্নিগ্ধ সবুজ এই উদ্ভিদটি বাড়ির শোভা বর্ধনে লাগানো যায়। খাবারে ফ্লেভারের জন্য লেমনগ্রাস খুব জনপ্রিয়। শুধু ফ্লেভারের জন্য না, এই গ্রাসে আছে সিট্রোনেলা তেল, যা বাড়িতে মশা-মাছি বা পোকামাকড়ের উপদ্রব কমাতে সাহায্য করে।

তুলসীগাছ পরিবেশকে জীবাণুমুক্ত ও বিশুদ্ধ রাখতে সাহায্য করে। তুলসীগাছের ঝাঁঝালো গন্ধ মশা তাড়াতে সাহায্য করে। এ ছাড়া তুলসীর রস প্রাকৃতিক কীটনাশক হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। পানি এবং প্রয়োজনীয় যত্ন নিলেই এটি বেঁচে থাকে।
অভ্যন্তরীণ উদ্ভিদগুলো কেবল বাড়ি নয়, কাজের জায়গারও নিখুঁত করে তোলে। কর্মক্ষেত্রে উদ্ভিদগুলো ডেস্কে রাখলে ইতিবাচকতার মাত্রা বাড়াতে সহায়তা করবে।

ছবি: পেকজেলসডটকম, আনস্প্ল্যাশডটকম ও উইকিপিডিয়া