সাজসজ্জার নতুন বন্ধু ভ্যানিটি

জেমস বন্ড সিরিজের সিনেমা ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ নট এনাফ’। এই ছবির অরিজিনাল সাউন্ড ট্র্যাকে ‘গারবেজ’ ব্যান্ডের লিড ভোকালিস্ট শার্লি মানসনকে একটা চারদিকে আলো জ্বলা আয়নার সামনে দেখেছিলেন কি? অথবা হলিউড না বলিউডের কোনো অভিনয়শিল্পীর ড্রেসিংরুমের সারি সারি আলোয় ঘেরা ড্রেসিং টেবিলটি? আলোয় ঘেরা সেই আয়না হচ্ছে ভ্যানিটি। কালের বিবর্তনে ড্রেসিং টেবিল নামের আসবাবটি কেবল একটা আসবাব নেই। এটি হয়ে গিয়েছে একটা ওয়ার্ক স্টেশন, নামও বদলে হয়েছে ভ্যানিটি।

ভ্যানিটি, ড্রেসিং টেবিলের চেয়ে একটু বেশি
ছবি: পেকজেলসডটকম

ভ্যানিটি মূলত একধরনের ড্রেসিং টেবিল। প্রচলিত ড্রেসিং টেবিলের মতোই এতে একটা আয়না আর সাজসজ্জার জিনিস রাখার জায়গা থাকে। তবে ভ্যানিটি শুধু একটা ড্রেসিং টেবিল নয়। এর কাজও আয়না ও প্রসাধনসামগ্রী রাখার শোকেসে সীমাবদ্ধ নেই। এখানে থাকে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা। আর সাজগোজের সঙ্গে জড়িত ইলেকট্রিক মেশিনগুলোকে চালানোর ব্যবস্থা।

গড়পড়তা একটা ভ্যানিটিতে মূলত চারটা জিনিসের মিলিত অবস্থান থাকে—
১. ভালো মানের বড়সড় একটা আয়না, যেন সঠিক বিম্ব পাওয়া যায়।
২. প্রচুর স্টোরেজের জায়গা, যেন সব প্রসাধনসামগ্রী এবং গয়না গুছিয়ে রাখা যায়।
৩. আয়নার তিন দিকে আলোর ব্যবস্থা, যেন নিখুঁত মেকআপ দেওয়া যায়।
৪. বৈদুতিক সংযোগ, যাতে চুলসজ্জার যন্ত্র চালানো যায়।

আয়নার সঙ্গে আলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ
ছবি: পেকজেলসডটকম

একটা সময় ছিল, যখন একজন নারীর সাজগোজের সরঞ্জাম কাজল, লিপস্টিক, পাউডার, ক্রিমের কৌটা, তেলের শিশি, পাউডারের কেসের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। একটু শৌখিনদের কাছে থাকত এক বা একাধিক পারফিউমের বোতল। এটুকু মেকআপের সরঞ্জাম দিয়ে সাজানো থাকত ড্রেসিং টেবিল। তাই সেখানে স্টোরজের থেকে বড় আয়না বা সুন্দর একটা আসবাব বানানোর দিকেই নজর দেওয়া হতো বেশি।

বর্তমানে মোটামুটি ফ্যাশনসচেতন নারী অনুষ্ঠান ও পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে ভিন্ন ভিন্ন রকমের সাজসজ্জা করেন। দিনের আলোয় হালকা মেকআপ, রাতের বেলায় ভারী মেকআপ করেন। সেই ভারী ও হালকা মেকআপেরও আছে নানা রকমফের। অফিসের পার্টিতে করপোরেট লুক, বিয়েবাড়িতে ভারী ট্র্যাডিশনাল লুক, জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তুলনামূলক কম ভারী মেকআপ, নো মেকআপ লুক, স্মোকি মেকআপ আরও কতশত নাম!

ভ্যানিটি, ড্রেসিং টেবিলের চেয়ে একটু বেশি
ছবি: পেকজেলসডটকম

এসব আলাদা আলাদা মেকআপের জন্য লাগে আলাদা আলাদা ধরনের ফাউন্ডেশন, কমপ্যাক্ট, ব্লাশ অন, আই শ্যাডো, লিপস্টিক, কনসিলার, কন্টুরিং কিট, প্রাইমার, মাশকারা, আই লাইনারসহ আরও অনেক কিছু। শুধু যে এগুলোর রং আলাদা, তা–ই নয়, কোনোটা পাউডার, কোনোটা ক্রিম আবার কোনোটা লোশনজাতীয়। সব মিলিয়ে সাজসজ্জা করতে ভালোবাসেন এমন প্রত্যেকের কাছেই কসমেটিকসের একটা বিশাল সংগ্রহ থাকে।

গতানুগতিক প্রসাধনসামগ্রী ছাড়াও যাঁরা নিখুঁত সাজ দিতে চান, তাঁদের কেশসজ্জার জন্যও নানা ধরনের হেয়ার স্ট্রেইটনার (চুল সোজা করার মেশিন), কার্লার (চুল কোঁকড়া করার মেশিন), ওয়েভার, ড্রায়ার রাখতে হয়। এত সাধের সাজগোজ যেন সঠিকভাবে দেওয়া যায়, সে জন্য দরকার হয় ভালো মানের একটা আয়না। মুখটিকে ভালোভাবে দেখার জন্য চাই চারদিক থেকে আসা উজ্জ্বল আলো। এই সব মিলিয়েই তৈরি হয় হালের ড্রেসিং টেবিল, যার কেতাবি নাম দেওয়া হয়েছে ‘ভ্যানিটি’।

মেকাপের সরঞ্জাম অনেক বেড়েছে
ছবি: পেকজেলসডটকম

বাংলাদেশে মোটামুটি নতুন হলেও ভ্যানিটির ধারণাটা একদম অজানা নয়। তবে বাজারে এখনো গতানুগতিক ড্রেসিং টেবিলই বেশি জনপ্রিয়। সেগুলোর কতগুলোতে ওপর থেকে আলো ফেলার ব্যবস্থা থাকে। তবে সেটি আদর্শ ভ্যানিটি নয়। ড্রেসিং টেবিল আর ভ্যানিটির মাঝামাঝি কিছু একটা। তবে যেকোনো ইন্টেরিয়র ডিজাইনার প্রতিষ্ঠান চাহিদামতো ভ্যানিটি বানিয়ে দেয়। এ ছাড়া কেউ যদি নিজেই মিস্ত্রি ঢেকে ভ্যানিটি বানাতে চান, তাদের জন্য ডি কোড ম্যানেজমেন্ট নামের একটা ইন্টেরিয়র ডিজাইনার প্রতিষ্ঠানের আর্কিটেক্ট শারমিন মমতাজ তন্বী দিয়েছেন কিছু পরামর্শ।

১. ভ্যানিটি আর সব সাধারণ ড্রেসিং টেবিলের মতোই। তবে ড্রেসিং টেবিল থেকে একটু বেশি কিছু। এখানে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে আয়না। এটা যদি ভালো মানের না হয়, তাহলে সাজ কিছুতেই নিখুঁত হবে না। তাই আয়নাতে বড় একটা বাজেট রাখুন। ভালো মানের একটা আয়নার দাম শুরু হয় ১০ হাজার টাকা থেকে।

২. আপনার কাছে যদি মেকআপ আইটেম অনেক বেশি হয়, তাহলে স্টোরেজের দিকে নজর দিন। অন্য ড্রয়ার থেকে এর পার্থক্য হচ্ছে ভ্যানিটির ড্রয়ারগুলো ছোট আর খাটো হয়। যতটুকু দরকার, ততটুকুই। আগেই ঠিক করে নিন কোন ড্রয়ারে কী রাখবেন। অযথা কোনো খালি জায়গা রাখার দরকার নেই। এতে একদিকে যেমন জায়গা নষ্ট হয়, অন্যদিকে খরচও বেড়ে যায়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, খালি জায়গায় বাতাস আটকে আপনার প্রসাধনসামগ্রী নষ্ট করে।

৩। ড্রয়ার ছাড়াও ছোট ছোট প্রসাধন রাখার জন্য খোপ বা আলাদা বক্স করে দেওয়া যায়। এতে একধরনের জিনিস একদিকে রাখা যাবে। কাঙ্ক্ষিত বস্তু সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে।

ভ্যানিটি, ড্রেসিং টেবিলের চেয়ে একটু বেশি
ছবি: পেকজেলসডটকম

৪. গয়না ঝুলিয়ে বা জায়গামতো রাখার জন্য হুক বানিয়ে নেওয়া যেতে পারে। জায়গা বাঁচানোর ব্যাপার থাকলে আয়নার পেছনেই চাপা একটা আলমারির মতো বানিয়ে তার দেয়ালে আলাদা আলাদা খোপে বা হুক দিয়ে গয়না ঝুলিয়ে রাখা যায়।

৫. কম দামি বোর্ডের স্থায়িত্বও কম হয়। অথচ বানানোর মজুরি মোটামুটি একই রকম। তাই একবারে সুন্দর, টেকসই, পরিষ্কার করতে সুবিধাজনক—এমন কিছু বানানোই ভালো। ঘরের অন্য ফার্নিচারের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে ভ্যানিটির রং ঠিক করতে পারেন। তবে অধিকাংশ মেকআপের অপিনিয়ন লিডাররা সাদা রঙের ভ্যনিটি ব্যবহার করেন।

৬. ভ্যানিটির আলো হওয়া উচিত উজ্জ্বল, অন্তত আয়নার দুই পাশ থেকে। তবে সবচেয়ে ভালো হয় যদি দুই পাশ আর ওপর থেকেও আলো ফেলতে পারেন। দুই পাশের আলো একই হতে হবে, কম বা বেশি হতে পারবে না। নয়তো সাজার সময় সমস্যা তৈরি করবে। আলোর জন্য এ ক্ষেত্রে লেড বাল্বের সারির পছন্দ করেন অনেকে।

কেশসজ্জা এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ
ছবি: কবির হোসেন

৭. চুলের মেকওভারের জন্য কিছু ব্রাশ, ক্লিপ, স্টেইটনার, কার্লার, ওয়েভার, হেয়ার ড্রায়ার—এগুলো রাখার জায়গা লাগে। এ জন্য আলাদা ক্যাবিনেট বা খোপ বানাবেন। যাতে গরম অবস্থায় ঝুলিয়ে রাখলেও কোনো সমস্যা না হয়। সবচেয়ে যেটা জরুরি, তা হচ্ছে, এগুলোর জন্য বৈদ্যুতিক সংযোগের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

৮. ভ্যানিটির একটা বিশেষ জরুরি বিষয় হচ্ছে, এতে বৈদুতিক সংযোগ থাকতে হয়। তাই ঘরের যেখানে বৈদুতিক সংযোগ আছে, সেই দেয়ালেই ভ্যানিটি স্থাপন করুন।
মোটামুটি ভালো মানের একটা ভ্যানিটি বানাতে আয়তনভেদে আপনার খরচ হবে ২৫–৫০ হাজার টাকার মতো। দামি প্রসাধনীগুলো গুছিয়ে রাখতে নিখুঁত একটা সাজের জন্য ভ্যানিটি একটা আদর্শ ব্যবস্থা।