বৈশ্বিক লিঙ্গ–অসমতা বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ)। ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২২’ শিরোনামের প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশ নিয়ে কয়েকটি খবর আছে, যার একটিতে দেশের মানুষ স্বস্তি পেলেও পেতে পারেন।
তবে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসার আগে, প্রতিবেদন অনুসারে, নারী-পুরুষের সমতার হিসাব-নিকাশের বৈশ্বিক অবস্থাটা দেখে নেওয়া যাক। বিশ্বজুড়ে এখন নারী-পুরুষ সমতা ৬৮.১ শতাংশ, গত বছরের তুলনায় যা সামান্য বেশি। সমতা পরিমাপের স্কেলটিতে শূন্য থেকে ১০০ পর্যন্ত ঘর আছে। স্কেলের সামনের দিকে এগোনোর মানে সমতার দিকে এগোনো। সেই হিসাবে পূর্ণাঙ্গ লিঙ্গসমতা অর্জন করতে আরও প্রায় ৩২ শতাংশ এগোতে হবে। বর্তমান হারে অগ্রগতি হলে আর এই পূর্ণ সমতা অর্জনে বিশ্বের সময় লাগতে পারে ১৩২ বছর। তবে বাংলাদেশের জন্য সেই অপেক্ষা ২০০ বছরে ঠেকতে পারে।
অত্যন্ত প্রগতিশীল ও ইতিবাচক মনোভাবসম্পন্ন শরীফ আহমেদ আর দিলারা হোসেন দম্পতির কথাই ধরা যাক (ছদ্মনাম)। তাঁদের এক ছেলে, এক মেয়ে। নিজের ছেলেমেয়েদের মধ্যে সমতা নিশ্চিত করবেন, সন্তানদের জন্মের পরপরই এই পণ করেছিলেন তাঁরা। ছেলেমেয়েকে সমানভাবে বড় করেছেন। সম্পদ সমানভাবে ভাগ করবেন, সেই ঘোষণা স্বজন ও বন্ধু মহলে জোরেশোরে দিয়ে রেখেছেন। অন্যদেরও তাঁদের পথ অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছেন। মেয়ের চাকরিতে প্রবেশের সময়ে দম্পতি জানতে পারলেন, ওই অফিসে পুরুষের চার ভাগের এক ভাগ মেয়ে কাজ করে। মেয়েকে ওই অসম পরিবেশে যোগ দিতে মানা করলেন। কিন্তু সমস্যা হলো, কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা আছে, তেমন কোনো জায়গাই এ দেশে খুঁজে পেলেন না তাঁরা। জেদি দম্পতি ভাবলেন, মেয়েকে এ দেশেই রাখবেন না। পাঠিয়ে দেবেন সমতার শীর্ষে থাকা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ আইসল্যান্ডে। তবে এই দম্পতির জন্য খবর হচ্ছে, আইসল্যান্ডেও নারী-পুরুষের পরিপূর্ণ সমতা নেই। সেখানে সমতার জন্য আরও ৬০ বছর অপেক্ষা করতে হবে।
সমতার বিশ্ব কেমন
সমতার বিশ্ব কেমন হতে পারে, সেটা বোঝাতে লিঙ্গ–অসমতার প্রতিবেদনটিতে চারটি সূচক ব্যবহার করা হয়েছে—স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ ও অংশগ্রহণের সুযোগ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। ওই চার সূচকে নারী ও পুরুষ সমান সমান হলে বলা যাবে সমতা অর্জন হয়েছে।
বৈশ্বিক হিসাবে ১৩২ বছর পর ওই সময়ে বসবাসকারী নারী-পুরুষ বলতে পারবেন, তাঁদের মধ্যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ ও কাজের সুযোগ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে কোনো অসমতা নেই। তাঁরা বলবেন, তাঁরা সমান সমান।
তবে প্রতিবেদনের নানা বিশ্লেষণ বলছে, সমতা অর্জনে বাংলাদেশকে আরও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ। আর লিঙ্গসমতা সূচকে সবচেয়ে নিচে অবস্থান করছে এ অঞ্চল। প্রতিবেদন অনুসারে, সমতা অর্জনে দক্ষিণ এশিয়ার সময় লাগতে পারে ১৯৭ বছর।
এবারের প্রতিবেদনে ১৪৬টি দেশের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। ২০০৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই প্রতিবেদনে ১০২টি দেশ নিয়মিত ছিল। সেই দেশগুলোর বর্তমান অগ্রগতির হার বিবেচনায় প্রতিবেদনে পূর্ণ সমতা অর্জনে আনুমানিক সময় তুলে ধরে বলা হয়েছে, শিক্ষায় ২২ বছর, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ১৫২ বছর এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে ১৫৫ বছর সময় লাগতে পারে। আর স্বাস্থ্যে সমতার পথে এগোনোর বিষয়টি স্থবির হয়ে থাকায় এ ক্ষেত্রে পূর্ণ সমতা অর্জনের আনুমানিক হিসাব বের করা যায়নি।
এ বছরের প্রতিবেদন অনুসারে, ১৪৬টি দেশে স্বাস্থ্য খাতে ৯৫.৮ শতাংশ, শিক্ষায় ৯৪.৪ শতাংশ, অর্থনীতিতে সম্পৃক্ততায় ৬০.৩ শতাংশ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে ২২ শতাংশ সমতা অর্জন করা গেছে।
সমতা অর্জনে সবচেয়ে কম সময় লাগবে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোর। নারী-পুরুষ সমান সমান হতে উত্তর আমেরিকার ৫৯ থেকে ৬২ বছর এবং ইউরোপের ৬০ বছর লাগতে পারে। লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের ৬৭ বছর, সাব সাহারা আফ্রিকার ৯৮ বছর, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার ১১৫ বছর, মধ্য এশিয়ায় ১৫২ বছর এবং পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ১৬৮ বছর সময় লাগবে।
সমতায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের পথে ধীরগতির জন্য করোনা মহামারিকে দায়ী করা হয়েছে। বলা হয়েছে, করোনার কারণে অর্থনৈতিক, সামাজিক দুরবস্থা ভবিষ্যতে সমতার অগ্রগতির পথেও বাধা তৈরি করবে। ২০২০ সালে অনুমান করা হয়েছিল, সমতা অর্জনে ১০০ বছর লাগবে। ২০২১ সালে সেই সময় ধরা হয় ১৩৬ বছর। এবার সময় চার বছর কমলেও করোনাকাল বিশ্বকে যে প্রজন্মগত ক্ষতির মধ্যে ফেলেছে তা পূরণ হবার না।
প্রতিবেদনে সেরা দশে শীর্ষে রয়েছে আইসল্যান্ড। স্কোর ৯০.৮ শতাংশ। এরপর ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড, সুইডেন, রুয়ান্ডা, নিকারাগুয়া, নামিবিয়া, আয়ারল্যান্ড ও জার্মানি।
বাংলাদেশের অবনমন
২০০৬ সালে প্রথম লিঙ্গ–অসমতা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে ডব্লিউইএফ। ৬২.৬ শতাংশ স্কোর নিয়ে ওই বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯১তম। ধাপে ধাপে বাংলাদেশ এগোলেও সেই ধারাবাহিকতা রাখতে পারেনি। ২০১৮ সালে ৪৮তম, ২০১৯ সালের প্রতিবেদনটি ওয়েবসাইটে নেই, করোনাকালে ২০২০ সালে ৫০তম এবং ২০২১ সালে ১৫ ধাপ নেমে ১৫৬টি দেশের মধ্যে ৬৫তম হয় বাংলাদেশ। এ বছর আরও ছয় ধাপ নেমে ৭১তম অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। স্কোর ৭১.৪ শতাংশ।
প্রতিবেদনে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার ১৫টি দেশের একটি হিসেবে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এই দেশগুলোতে বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ নারীর বাস। বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে শিক্ষায় সমতার ক্ষেত্রে আগের চেয়ে কিছুটা অবনতি হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সমতা আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। সব মিলিয়ে শিক্ষায় আগের বছরের তুলনায় দুই ধাপ নেমে অবস্থান হয়েছে ১২৩তম।
রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ ভালো। বৈশ্বিকভাবে নবম স্থানে। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অবস্থান বাংলাদেশের পরে—৪৮তম। তবে এ বছর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ দুই ধাপ নেমেছে।
অর্থনীতিতে সম্পৃক্ততায় নারী ও পুরুষের সংখ্যা কমেছে এ বছর। নারীর সংখ্যা বেশি কমেছে। তবে পুরুষের চেয়ে নারীর উপার্জন বেড়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে সমতা বেড়েছে। গত বছরের চেয়ে ছয় ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ দাঁড়িয়েছে ১৪১তম অবস্থানে। স্বাস্থ্যে সমতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাঁচ ধাপ এগিয়ে এবার ১২৯তম।
দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে বাংলাদেশ
শুরুতে কিছুটা স্বস্তি পাওয়ার যে খবরের কথা বলা হয়েছিল, সেটি হচ্ছে, সমতার দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থা ‘মন্দের ভালো’। দক্ষিণ এশিয়া বলতে আটটি দেশের কথা জানি আমরা। তবে প্রতিবেদনে ইরানকেও দক্ষিণ এশিয়াভুক্ত করা হয়েছে। এই ৯টি দেশের মধ্যে সমতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর সবচেয়ে ভালো। এরপর রয়েছে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ভুটান, ভারত, ইরান, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। বৈশ্বিক তালিকায় সবচেয়ে নিচে ১৪৫ ও ১৪৬তম স্থানে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হকের মতে, পরিবারে বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিকতা সমতার দিকে এগোনোর পথে বড় বাধা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বাংলাদেশে নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের লক্ষ্যে কার্যকর ফল পেতে হলে সরকারকে এখন পরিবারকেন্দ্রিক কাজে হাত দিতে হবে। পরিবার থেকেই একটি সমতার রাষ্ট্র পাওয়া সম্ভব। সমতার ভিতগুলোকে টেকসই করতে হবে, যেন কোভিডের মতো কোনো পরিস্থিতি ভবিষ্যতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়া, বাল্যবিবাহ বাড়িয়ে তোলা বা অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজের জায়গায় নারীদের অংশগ্রহণ কমিয়ে দিতে না পরে।