বড় কান থাকা জরুরি

যুক্তরাষ্ট্রের সিটি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জেন ফ্রেজার। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি ব্যাংকিং ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি স্টার্ন স্কুল অব বিজনেসের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মূল বক্তা ছিলেন তিনি। পড়ুন তাঁর বক্তৃতার নির্বাচিত অংশ।

জেন ফ্রেজার
ছবি: সংগৃহীত

শিক্ষা ও পেশাজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্বটা তোমাদের সামনে অপেক্ষা করছে। কোনো বি-স্কুল (বিজনেস স্কুল) থেকে এটা তোমরা পাবে না। এই পর্বের জ্ঞান তোমাকে নিতে হবে ‘ই-স্কুল’ থেকে। ‘ই’ মানে ‘এমপ্যাথি’ (সমানুভূতি)।

হয়তো ভাবছ, ব্যবসায় শিক্ষার সঙ্গে সমানুভূতি শিক্ষার কী সম্পর্ক? সমানুভূতি, সহমর্মিতা তো আবেগের বিষয়। আর আবেগ, অনুভূতি নিয়ে কাজ করতে চাইলে তো তোমরা নিশ্চয়ই নার্সিং বা শিল্পকলা, সমাজসেবা নিয়ে পড়তে। তোমাদের মাথায় এমন ভাবনা এলে ভুল হবে না। কারণ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ব্যবসার সঙ্গে আমরা সহমর্মিতাকে মেলাতে পারিনি। এত দিন সবাই ভেবে এসেছেন, একে অপরকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার কায়দা শিখতে পারলেই ব্যবসার জগতে সফল হওয়া যায়। কিন্তু আমার নিজের পেশাজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, সহমর্মিতাই ব্যবসার দুনিয়ায় সফল হওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং এই শিক্ষার চর্চা করা আমাদের জন্য অপরিহার্য।

আরও পড়ুন

সহমর্মিতা আমাদের তুখোড় প্রতিযোগী হতে সাহায্য করে। একজনকে আরেকজনের সঙ্গে যুক্ত করে। পরিচিতি, চিন্তা, দক্ষতার পরিধি বাড়ায়। সহমর্মিতা আমাদের সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে শেখায়, মাটির সঙ্গে ধরে রাখে। আর এসব কারণেই আমাদের সবার জন্য ‘ই-স্কুল’ অপরিহার্য।

‘ই-স্কুলে’ কোনো ক্লাসরুম নেই, কোনো লেকচার নেই, কোনো অধ্যাপক নেই; এখানে কোনো পরীক্ষাও হয় না। কিন্তু পদে পদে তুমি তোমার ভালো পারফরম্যান্সের ফল পাবে। তোমাকে পয়সা খরচ করে কোথাও পড়তে হবে না। কিন্তু যে শিক্ষা তুমি প্রতিনিয়ত পাবে, সেগুলো অমূল্য। ‘ই-স্কুলে’ কোনো দিন সমাবর্তন হয় না, কারণ এখান থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়া যায় না। এই শিক্ষার কোনো শেষ নেই।

প্রতিষ্ঠানের প্রাণ হচ্ছে কর্মী

বি-স্কুলে তোমরা এত দিন শিখেছ হিসাববিজ্ঞান, পরিসংখ্যানের মতো সংখ্যায় ভরপুর বিষয়–আশয়। এখন ই-স্কুল তোমাদের শেখাবে সংখ্যা আর সূত্রের পেছনের বিষয়গুলো। আমি এখনো ই-স্কুলের একজন গর্বিত শিক্ষার্থী। আমি এখনো প্রতিনিয়ত সমানুভূতির চর্চা করে যাচ্ছি। সম্প্রতি আমি সমানুভূতির চূড়ান্ত চর্চা দেখে এসেছি এবং সেখান থেকে শিক্ষাও গ্রহণ করেছি। তোমাদেরও সেই অভিজ্ঞতা শোনাতে চাই।

আমার প্রতিষ্ঠান ‘সিটি’ই একমাত্র মার্কিন ব্যাংক, যারা এখন যুদ্ধাক্রান্ত ইউক্রেনে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তাই এই যুদ্ধ আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ও কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবেও প্রভাবিত করছে। এই যুদ্ধ আমাদের সহকর্মী ও গ্রাহকদের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। তাই ব্যবসার আগে আমাদের অগ্রাধিকারে প্রথমেই জায়গা করে নিয়েছে মানবিক সংকট মোকাবিলা। আমরা বিভিন্ন সময় আমাদের যুদ্ধাক্রান্ত সহকর্মী ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রাহকদেরও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে পোল্যান্ডে শরণার্থী শিবির পর্যন্ত নিয়ে যেতে সাহায্য করেছি। যুদ্ধাবস্থায়ও কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি, কারণ এর ফলে ইউক্রেনে বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা জরুরি প্রয়োজনে অর্থ লেনদেন করতে পারছে। এই পরিস্থিতিতে ব্যবসা নয়, আমাদের কাছে মানবিক বিপর্যয় সামাল দেওয়াটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে।

খেয়াল করে দেখবে, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের প্রাণ হচ্ছে এর কর্মীরা। আর সেই প্রতিষ্ঠানই সফলতার চরম শিখরে পৌঁছেছে, যারা এবং যার কর্মীরা মানবতা ও সহমর্মিতাকে উদ্‌যাপন করেছে, সমানুভূতির চর্চা করেছে।

অহংবোধ দূরে রাখো

বেশ কয়েক বছর ‘সিটি’তে চাকরি করার পর আমি সমানুভূতি চর্চার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছি। তখন লন্ডনে সিটির একটি শাখার প্রধানের দায়িত্বে ছিলাম। আমার পেশাজীবন খুবই চকমকে রঙিন মোড়কে মোড়া ছিল। কিন্তু আমি নতুন চ্যালেঞ্জের খোঁজে কাতর ছিলাম। তাই হঠাৎই সিদ্ধান্ত নিই, লন্ডনের ব্যাংকিং শাখা ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিজৌরিতে সিটির বন্ধকি শাখার ব্যবসায় মন দেব। ওই সময় আবাসন ব্যবসার অস্থিরতা ও আর্থিক সংকটের কারণে ব্যাংকগুলোর বন্ধকি শাখার অবস্থা ছিল যাচ্ছেতাই। কোনোভাবেই লাভের মুখ দেখা যাচ্ছিল না। আমাদের মতো আমাদের গ্রাহকেরাও সংকটে ছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে ওই ব্যবসার হাল ধরতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। শুরুতেই বুঝতে পারলাম, পদ বা পদবি পেলেই নেতৃত্ব দেওয়া যায় না। নেতৃত্ব অর্জন করে নিতে হয়। প্রচণ্ড চাপ ছিল আমার ওপর। দ্রুত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। আমিও ব্যবস্থা নিলাম। তেমন বিশেষ কিছু নয়। শুধু কথা শুনে গেছি।

বড় কান থাকা খুব জরুরি। ঠিক শুনেছ, বড় কান! মানে হলো, নিজের অহংবোধকে (ইগো) পার্ক করে সাইডে রেখে, আরেকজনের চিন্তা, দুশ্চিন্তা, এমনকি সমালোচনা শোনার অভ্যাস করা। না শুনলে তুমি শিখতেও পারবে না। আরেকজনের জুতায় পা না গলালে আরেকজনের মানসিকতা তুমি বুঝবে না। আর আরেকজনকে বোঝার ক্ষমতা আমাদের না থাকলে বড় বড় আলোচনায়, ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে যাব। সেবার বন্ধকি শাখার দায়িত্ব নেওয়ার পর সবার কথা শুনেছিলাম, তাই সবার প্রতি সমানুভূতি দেখাতে পেরেছি। আর এ জন্যই যে ব্যবসা প্রায় বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে ছিল, সমানুভূতি দিয়ে সেটা আমরা ফিরিয়ে আনতে পেরেছি।

নিজের প্রতি সহমর্মী হও

সমানুভূতির সবচেয়ে চরম শিক্ষা আমরা পেয়েছি গত দুই বছরে, বৈশ্বিক মহামারির সময়। এ সময় আমরা সবাই একে অপরের জুতায় পা গলানোর সুযোগ পেয়েছি। পুরোনো নিয়মকানুন আর প্রথার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে মানবতাকে প্রাধান্য দিয়েছি। আমি আমার প্রায় সব সহকর্মীর বাচ্চাদের নাম মহামারির সময় শিখে ফেলেছিলাম। ব্যবসার দুনিয়ায় যে আইডিয়া কেউ কোনো দিন ভাবতে পারেনি, মহামারি আমাদের সেই আইডিয়ার চর্চা করা শিখিয়েছে। আইডিয়াটা হলো—‘কাজ–জীবনের ভারসাম্য’র গুরুত্ব।

স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পরও আমরা মিশ্র অফিস ব্যবস্থা চালু রেখেছি। আমরা ‘জুম ফ্রি ফ্রাইডে’ উদ্‌যাপন শুরু করেছি। এসব চর্চা আমাদের ব্যক্তি ও পেশাজীবনকে সহজ করেছে, দিয়েছে স্বস্তি। কাজের প্রতি আমাদের আরও উদ্যমী করেছে, কাজের মানও বেড়েছে।

শেষ কথা হিসেবে বলব, সহমর্মিতার চর্চা করতে গিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির প্রতি সহানুভূতিশীল হতে ভুলে যেও না। সেই ব্যক্তি হলো তুমি নিজে। নিজের প্রতি সহমর্মী হও। নিজের প্রতি যত্নশীল হলে, সহমর্মী হলে, সব ধরনের প্রতিবন্ধকতায়ও তুমি বেড়ে উঠতে পারবে। লক্ষ্যের পেছনে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত না হয়ে নিয়মিত বিরতি নাও, নিজেকে বেড়ে উঠতে দাও।

ইংরেজি থেকে অনূদিত

সূত্র: নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি স্টার্নের ইউটিউব চ্যানেল থেকে