চিরাচরিত অফিসের গুমোট অস্থিরতা আর কৃত্রিম আন্তরিকতা এখানে নেই

আনিকা প্রতীতি
ছবি: সংগৃহীত

ছোটবেলা থেকেই আমি ‘প্রথম আলো’র নিয়মিত পাঠক। পত্রিকা পড়তে পড়তে কখনো হেসেছি, কখনো কেঁদেছি, কখনোবা ভেবেছি, আমিও কি একদিন খবরের শিরোনাম হব! কিন্তু কোনো দিনই ভাবিনি, সংবাদ সংগ্রহের পেছনের কারিগর হিসেবে একদিন কাজ করব।
১০ বছর আগের কথা। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। হঠাৎ একদিন দেখলাম, ‘প্রথম আলো’র সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র ‘স্বপ্ন নিয়ে’তে ‘আমার স্বপ্ন’ বিষয়ে লেখা আহ্বান করা হয়েছে। কেন জানি না, আমারও ইচ্ছা হলো লেখা জমা দেওয়ার। উড়ু উড়ু মনের স্বপ্নগুলোকে কলমবন্দী করলাম, সাদা খাতায় আঁকলাম আমার হরেক রঙের স্বপ্ন—বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের র‍্যাঙ্কিংয়ে ১ নম্বর স্থান দখলের স্বপ্ন, ঢাকা শহর যানজটমুক্ত হওয়ার স্বপ্ন, নিজের উচ্চতর গবেষণা করার স্বপ্ন। এরপর দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করছিলাম, লেখা ছাপা হবে তো? অবশেষে ছাপার হরফে নিজের নাম আর লেখা দেখে একরাশ মুগ্ধতা কাজ করছিল মনে! সেই শুরু।
স্পষ্ট মনে আছে সেদিনের কথা, যেদিন ‘প্রথম আলো’র অফিসে প্রথম গেলাম। অফিস মানেই আমার চোখে ভেসে উঠত কাঠখোট্টা পরিবেশ, যেখানে সবাই গোমড়া মুখে বসে বসে একঘেয়ে কাজ করে। কিন্তু ‘প্রথম আলো’র অফিসটা আমায় অবাক করল। চিরাচরিত অফিসের গুমোট অস্থিরতা আর কৃত্রিম আন্তরিকতা এখানে নেই। সবাই আপন, সবাই শুভাকাঙ্ক্ষী, সবাই সদা মেতে আছে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আড্ডায় আর নির্ভেজাল হাসিতে। এর পর থেকে শখের বশেই টানা তিনটা বছর লেখালেখি করেছি আমার প্রিয় জাতীয় দৈনিকে। একবারও মনে হয়নি ‘কাজ’ করছি। বরং মনে হতো, এত দিনে নিজের সুপ্ত সৃজনশীলতাকে বিকশিত করার একটি প্ল্যাটফর্ম পেয়েছি। শুধু লেখালেখিই নয়, সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে বিশ্বের চলমান ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে ধারণা পেতাম। পাঠক হিসেবে হয়তো সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো একরকম দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পড়তাম। তবে বোদ্ধা সহকর্মীরা আড্ডার ছলেই সেগুলো নিয়ে মুক্ত আলোচনা, পক্ষে-বিপক্ষে মতামত, চুলচেরা বিশ্লেষণ করতেন, যা আমার মনের বন্ধ জানালাটা খুলে দিয়েছিল। সবাই মিলে একসঙ্গে ক্রিকেট খেলা দেখতে যাওয়া, একসঙ্গে ইফতার পার্টি করা—এমন অনেক সুখস্মৃতিও আছে।

আরও পড়ুন

সাংবাদিকতা আগে কখনো করিনি। তাই প্রথম প্রথম বেশ ভয় কাজ করত, লেখা ভালো হচ্ছে তো? কিন্তু আস্তে আস্তে এ জড়তা কেটে গেল, বাড়ল আত্মবিশ্বাস। সহকর্মীরাই ছিলেন আমার সমালোচক। আমার অন্যতম লক্ষ্য ছিল বিজ্ঞান, বিশেষ করে জীববিজ্ঞানের ফলিত বিষয়গুলোকে জনসাধারণের কাছে সহজ ভাষায় পৌঁছে দেওয়া। প্রদায়ক হওয়ার সুবাদে পরিচয় হয়েছিল অনেক গুণীজনের সঙ্গে। মেধাবী মুখের সাক্ষাৎকার নিতে নিতে নিজেই অনুপ্রাণিত হতাম, মেধাবীদের স্বপ্ন যেন আমাকেও ছুঁয়ে যেত। একদিন বাসে করে যাচ্ছি, এমন সময় শুনতে পেলাম, একদল প্রাণোচ্ছল তরুণ-তরুণী আমার লেখা একটি প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা করছেন। কী যে ভালো লেগেছিল সেদিন! অর্থ নয়, কীর্তি নয়, খ্যাতির মোহ নয়, নিখাদ ভালোবাসার টানেই লিখতাম এবং ছাপার হরফে নিজের লেখা দেখে ভীষণ আনন্দ পেতাম! একেক সময় মনে হতো, পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে লেখালেখিতেই নিয়মিত হই। কিন্তু বিধি বাম, পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর ক্যারিয়ারের চাকা ঘুরে গেল অন্যদিকে। বয়ে গেল অনেকটা সময়। উচ্চতর গবেষণার হাতছানিতে পাড়ি জমালাম স্বপ্নের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে। লেখালেখির লাগাম টেনে থিতু হলাম নীরস গবেষণাগারে। দীর্ঘ ছয় বছর সেখানে কাটিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরেছি। তবে এত স্বপ্নপূরণের ভিড়ে মনের কোণের লেখক হওয়ার ছোট্ট স্বপ্নটি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে তাই মনে হয়, যে জীবন বিজ্ঞানের, গবেষণার; সাহিত্যের সঙ্গে তার হয় নাকো দেখা!
লেখা ছেড়েছি অনেক বছর হলো, কিন্তু এখনো দ্রুত হাতে জরুরি নোট নেওয়ার দক্ষতা, সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে পরিচিত-অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ, সংবাদ বিশ্লেষণের ক্ষমতা আর তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সত্য–মিথ্যা যাচাই করে রিপোর্ট আকারে সংবাদ পরিবেশনের পেশাদারি মনোভাব আমায় ছেড়ে যায়নি। গবেষণার প্রয়োজনেই লিখতে হয়েছে থিসিস, বিজ্ঞান প্রবন্ধ, প্রজেক্ট গ্রান্ট, সিনোপসিস, অ্যাবস্ট্রাক্ট; আর তখনই আবিষ্কার করেছি, সহজ–সরল ভাষায় বেঁধে দেওয়া শব্দসীমার মধ্যে লিখে নির্দিষ্ট ডেডলাইনের মধ্যে জমা দেওয়ার সহজাত দক্ষতা আমার কাজকে অনেক সহজ করে দিয়েছে, যে দক্ষতা অর্জন করেছিলাম ‘প্রথম আলো’ থেকেই। তাই তো দেশ–বিদেশের নানা প্রতিষ্ঠানে কাজের অভিজ্ঞতা থাকলেও এখনো সবাইকে বুক ফুলিয়ে বলি, আমার প্রথম কর্মস্থল—‘প্রথম আলো’।