যেভাবে শুরু হলো ‘বাসার ভাই’
‘এই, বাসার ভাইটা কে? এটা কি তুমি? নাকি তোমার অফিসের কেউ?’—এমন প্রশ্ন আমাকে শুনতে হয় নিয়মিতই। প্রথম আলোর ৫ নম্বর পৃষ্ঠায় প্রতিদিন প্রকাশিত হচ্ছে কমিক স্ট্রিপ ‘বাসার ভাই’। কমিকটি শুরু হওয়ার পর থেকে লেখক হিসেবে এমন নানা প্রশ্নের সামনে পড়তে হচ্ছে আমাকে। রস+আলো, কিশোর আলোতে নিয়মিত কমিক লিখলেও দৈনিক পত্রিকার জন্য কমিক লেখা আমার জন্যও নতুন অভিজ্ঞতা। একেবারে হুট করেই শুরু হয়েছিল ‘বাসার ভাই’। করোনার প্রকোপে পুরো দেশের মানুষ তখন গৃহবন্দী। ২০২০ সালের এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে বন্ধ হয়ে গেল প্রথম আলো কার্যালয়ও। রাত-দিন চালু থাকা পত্রিকা অফিস যে কখনো বন্ধ হতে পারে, কল্পনাই করিনি আমরা। শুরু হলো বাসা থেকেই পত্রিকা বের করার কষ্টসাধ্য কাজ। দিন-রাতের হিসাব নেই কারও। মহামারির কঠিন সময়ে ঘরে বসে দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ চাট্টিখানি কথা নয়। আমাদের জীবন তখন স্ক্রিনে বন্দী। ফোনে যোগাযোগ আর ল্যাপটপে কাজ—চলছিল এভাবেই। এ রকমই এক রাতে ফোন করলেন প্রথম আলোর সহকারী ফিচার সম্পাদক মাহফুজ রহমান। বললেন, ঘরে আটকে থাকতে থাকতে সবাই হতাশ, বিষণ্ন। তার ওপর প্রতিদিন করোনায় মানুষের মৃত্যুর খবর। সব মিলিয়ে ভয়াবহ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে মানুষ। সম্পাদক মতিউর রহমান চান এমন কিছু, যা কিছুটা হলেও মানুষকে আনন্দ দেবে। এত এত খারাপ খবরের ভেতরে পাঠককে একটু স্বস্তি দিতে পারে—এমন কিছু করা যায় কি না। সেটা হতে পারে একটা ধারাবাহিক কমিকস।
সঙ্গে সঙ্গে জুম মিটিংয়ে বসে গেলাম আমরা। মাহফুজ রহমান, ফিচার বিভাগের সহসম্পাদক মো. সাইফুল্লাহ আর আমি—তিনজন মিলে শুরু করলাম প্রাথমিক আলোচনা। মোটামুটি একটা কাঠামো দাঁড় করানোর পর যোগ দিলেন কার্টুনিস্ট আরাফাত করিম। কী নিয়ে কমিকস হতে পারে, কেমন হবে চরিত্রগুলো তা নিয়ে মিটিং করলাম আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বিজ্ঞানের অবিস্মরণীয় উন্নয়নের এই সময়ে সব শ্রেণি-পেশার মানুষই আজকাল খুব সিরিয়াস। কাউকে নিয়ে কৌতুক-কমিকস করা খুব কঠিন। আমরা ঠিক নিশ্চিত হতে পারছিলাম না যে মূল চরিত্রের পেশা কী হবে। এমন চরিত্র, যাকে নিয়ে মজা করলে সে রকম কোনো প্রতিক্রিয়া আসবে না। ভেবে দেখলাম, বাংলাদেশে এ রকম পেশা আছে একটাই—সাংবাদিকতা। সবারই তোপের মুখে পড়তে হয় সাংবাদিককে। তা ছাড়া আমাদের চারজনেরই প্রিয় কমিকস চরিত্র টিনটিনও একজন সাংবাদিক। তাই কমিকসের চরিত্র হিসেবে সাংবাদিককেই বেছে নিলাম আমরা। এরপরই পড়লাম বিপদে। কমিকসের নাম কী হবে? চারজন মিলে রাত-দিন জুম মিটিং করেও কোনো নাম ঠিক করতে পারলাম না।
পরদিন আবার ফোন করলেন মাহফুজ ভাই। অভ্যাসবশত জিজ্ঞেস করলেন,
‘আপনি কই, বাসায়?’
‘জি ভাই। এখন তো সবাই বাসায়।’
তারপর আমরা নাম কী হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা শুরু করলাম আবার। রাতে আমাদের মেসেঞ্জার গ্রুপে মাহফুজ ভাই লিখলেন, ‘আচ্ছা, সবাই তো এখন বাসার ভেতরে। তার মানে সবাই এখন ‘বাসার ভাই’। এটাই নাম হলে কেমন হয়?’
সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম আমরা। আমাদের বিজ্ঞানচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসার। নিপাট ভদ্রলোক। তাঁর সঙ্গে নামটা মিলে গেল। বাসার ভাইয়ের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য আমরা নিলাম কমিস চরিত্র ‘বাসার’কে গড়ে তোলার জন্য। খুব দ্রুত ক্যারেক্টার ডিজাইন করে ফেললেন আরাফাত করিম। সম্পাদকের সবুজসংকেত পাওয়ার পর শুরু হলো লেখার কাজ।
প্রথমে ঠিক হয়েছিল, আমরা তিনজন মিলেই লিখব বাসার ভাই কমিকস। কিন্তু মাহফুজ রহমান ও মো. সাইফুল্লাহ সুকৌশলে ব্যাপারটা চাপিয়ে দিলেন আমার ওপর। তারপর আর কী, ২০২০-এর জুলাইয়ে শুরু হওয়া বাসার ভাই ১১ নভেম্বর পার করল ৮১৪তম পর্ব।
বাসার ভাই কমিকস শুরু হয়েছিল পরীক্ষামূলকভাবে। করোনার মধ্যে চালু হওয়া এই কমিক স্ট্রিপ শুরু থেকেই ছিল করোনামুক্ত। আমরা চেয়েছিলাম, অন্তত এই কমিকে যেন মানুষ করোনা, মাস্ক, হাসপাতাল—এগুলো থেকে একটু ভিন্ন দিকে চোখ সরাতে পারে। তবে আমরা কল্পনাও করিনি এই কমিকস এত দিন ধরে চলবে। পাঠকেরা পড়ছেন বলেই চলছে বাসার ভাই, বাবু, মাখনের কাণ্ডকীর্তি।
‘বাসার ভাই’ কমিক নিয়ে প্রতিদিনই পাঠকদের মতামত পাই আমরা। অনেকে আবার আগে থেকে অনুমান করে কমেন্টে লেখেন যে পরের পর্বে কী হবে। কেউ কেউ আবার ধরে ফেলেন সূক্ষ্ম ভুলও। ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করি আমরা। পাঠকেরা যেমন অপেক্ষায় থাকেন বাসার ভাই কমিকের জন্য, আমরাও একই রকম অপেক্ষায় থাকি তাঁরা কী মন্তব্য করলেন, কেমন লাগল এগুলো জানার জন্য। পাঠকদের ভালো লাগলে আরও অনেক দিন ছুটবে বাসার ভাই, বাবু, মাখনরা।