বিইউএফটিতে শেখা ও নেটওয়ার্কিংয়ের বড় সুযোগ

বিইউএফটি ক্যাম্পাসে আছে হাতে–কলমে শেখার সুযোগছবি: সুমন ইউসুফ

সারা বিশ্বে পোশাকের প্রায় ১ দশমিক ৮৪ ট্রিলিয়ন ডলারের এক বিশাল বাজার আছে। আকারে এটি স্মার্টফোনের বাজারের তুলনায় প্রায় চার গুণ বড়। সারা বিশ্বেই এই খাতে দক্ষ মানবসম্পদের চাহিদা বাড়ছে। বাংলাদেশের গ্র্যাজুয়েটরা যেন এই বৈশ্বিক বাজারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন, সে কথা মাথায় রেখেই সাজানো হয়েছে বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ‍্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউএফটি) কোর্সগুলো। সাড়ে ৬ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭টি অনুষদের ১৫টি প্রোগ্রামে পড়ছেন। গত ১০ জুলাই বৃষ্টিস্নাত এক সকালে আমরা হাজির হই বিইউএফটিতে। ঢাকার তুরাগের নিশাতনগরে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস।

সময়ের সঙ্গে তাল রেখে শেখা

দেশের পোশাকশিল্প খাতের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ আছে বলেই বিইউএফটির অনেক স্নাতক এরই মধ্যে নামী বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করতে শুরু করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, ওয়ালমার্ট, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার, এইচঅ্যান্ডএম, লি অ্যান্ড ফাং, জারাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন তাদের অ‍্যালামনাইরা।

আরও পড়ুন

দেশীয় পোশাক খাতে বিইউএফটির যে গ্র্যাজুয়েটরা অবদান রাখছেন, তাঁদের মধ‍্যে একজন আফসানা ফেরদৌসী। এরই মধ‍্যে ফ‍্যাশন ডিজাইনার হিসেবে তাঁর একটি স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে উঠেছে। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে আফসানা বলছিলেন, ‘ক্যাম্পাসের লাইব্রেরিতে বইপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতেই আমার ফ‍্যাশন ডিজাইনার হওয়ার স্বপ্ন দেখার শুরু। স্কেচিং, প্যাটার্ন, ড্র্যাপিং ও সুইং, প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্টসহ বিভিন্ন বিষয় হাতে–কলমে শিখতে হয়েছিল। বিইউএফটির একটা ভালো দিক হলো, এখানে শুধু সৃজনশীলতার চর্চাই নয়, কারিগরি দিকগুলোও শেখানো হয়। দেশের বিভিন্ন গার্মেন্টসের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক আছে বলেই এখানকার শিক্ষার্থীদের নেটওয়ার্কিং ও কাজের সুযোগ বেশি।’

আইয়ুব নবী খান, ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি
ছবি: সুমন ইউসুফ
সাতটি অনুষদের অধীনে বিইউএফটিতে ১৫টি প্রোগ্রাম। চালু আছে তিনটি সার্টিফিকেট ও একটি ডিপ্লোমা কোর্স। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কোর্স ডিজাইনে ইন্ডাস্ট্রির চাহিদাকে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমরা যেমন দক্ষ পেশাজীবী তৈরি করছি, তেমনি শিল্প খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণার জন্যও শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিচ্ছি। ৫২টি ল্যাবের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তি থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে–কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। গত এক দশকে বাংলাদেশের গার্মেন্টসসহ টেক্সটাইল খাতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজেদের একটা জায়গা করে নিয়েছেন।
আইয়ুব নবী খান, ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি

শিক্ষার্থীরা কী বলছেন

শিল্প খাতের চাহিদা ও প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিনিয়ত হালনাগাদ করা হয় বিইউএফটির পাঠ্যক্রম। এখানে পড়ানো হয় মার্চেন্ডাইজিং, ডিজাইন ও মার্কেটিং, লিন ম্যানুফ্যাকচারিং, প্রোডাকশন প্ল্যানিং, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং, টেক্সটাইল প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনা, গার্মেন্টস কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সিস্টেম, ফেব্রিক অপ্টিমাইজেশনসহ বিভিন্ন বিষয়। কক্সবাজার থেকে এখানে পড়তে এসেছেন অ্যাপারেল ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড টেকনোলজির ছাত্র মেহরাব মাহি। তিনি বলছিলেন, ‘ভবিষ্যতে বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের কারিগরি খাতে কাজ করার ইচ্ছা আছে। তাই এই বিষয় বেছে নিয়েছি। তৈরি পোশাক খাতে যেসব আধুনিক প্রযুক্তির ব‍্যবহার হচ্ছে, সেসব সম্পর্কে আমাদের জানতে হয়। ব‍্যবহারিক শিক্ষার ওপরই জোর দেওয়া হয় বেশি।’

টেক্সটাইল প্রকৌশল ও ব‍্যবস্থাপনায় পড়ছেন মশিউর রহমান। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সবুজ মাঠে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন তিনি। মশিউর বলেন, ‘আমি ব্যবসা করতে চাই। সে জন‍্য বিবিএ পড়তে চেয়েছিলাম। পরে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যানেজমেন্টে ভর্তি হই। এখানে বিবিএতে যেসব বিষয়ে পড়ানো হয়, সেসব কোর্স তো আছেই, সঙ্গে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিভিন্ন বিষয়ও আমাদের পড়ানো হচ্ছে। প্রায় প্রতি সেমিস্টারেই আমাদের বিভিন্ন শিল্পকারখানায় শিক্ষাসফরে যেতে হয়। বাস্তবের দুনিয়ার গার্মেন্টস বা বিভিন্ন কারখানা কীভাবে চলে, আমরা সরাসরি দেখতে পারি। ইন্টার্নশিপ ও অন দ্য জব ট্রেনিংয়ের সুবিধাও আছে।’

সৃজনশীলতা চর্চার নানা সুযোগ এই ক‍্যাম্পাসে আছে। এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রুবাইয়াত জাহান বলছিলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহারিক শিক্ষার অংশ হিসেবে ফ্যাশন এক্সিবিশন ও ফ্যাশন শো আয়োজন করা হয়। নিজেদের ভাবনা ও সৃষ্টি আমরা এসব প্রদর্শনীতে তুলে ধরার সুযোগ পাই। নিজেরাই র‍্যাম্পে হাঁটি। নামী ফ্যাশন ডিজাইনাররা এসব প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে উপস্থিত থাকেন। পণ্য কীভাবে টেকসই হতে পারে, সাশ্রয়ী উপকরণ দিয়ে কীভাবে পণ্য তৈরি করা যায়, এমন নানা আইডিয়া উপস্থাপনের সুযোগ এ আয়োজনগুলোয় থাকে। অনেকে তাঁদের ব্যবসার ভাবনাও প্রদর্শনীর মাধ্যমে তুলে ধরেন। আমরা বিভিন্ন পোশাকের নকশা করি। কখনো চট দিয়ে ব্যাগ বানাই, কখনো চামড়া দিয়ে জুতা।’

ঢাকার তুরাগের নিশাতনগরে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস
ছবি: সুমন ইউসুফ

উদ্যোগ বিকাশের সুযোগ

ক‍্যাম্পাস ঘুরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, সবাই যে চাকরির পেছনে ছুটতে চান, তা নয়। উদ‍্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নও অনেকে দেখছেন। চতুর্থ বর্ষের হাসানুল আমিন যেমন বলছিলেন, ‘পোশাকশিল্পে অনেক সময় শিপমেন্ট বাতিল হয়ে যায়। এ–সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের জন‍্য একটা স্টার্টআপ শুরু করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অ্যালামনাইরা সহায়তা করছেন বলেই আসলে সাহস করেছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের যেমন চাকরির বাজারের জন্য তৈরি করা হচ্ছে, তেমনি এখনকার বাস্তবতায় উদ্যোক্তা হওয়ার নানা কৌশলও শেখানো হচ্ছে। অনেক অ্যালামনাই নিজেরা বিভিন্ন স্টার্টআপ ও ফ্যাশন প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন।’

প্রথম বর্ষে কেবল ভর্তি হয়েছেন সানজিদা রহমান। ফ্যাশন স্টাডিজের এই শিক্ষার্থী বলছিলেন, ‘আমার ফ্যাশন উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন। হাতে–কলমে বিভিন্ন বিষয় শিখতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি।’ বিবিএর কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘অন‍্য কোনো বিশ্ববিদ‍্যালয়েও বিবিএ পড়তে পারতাম। এখানে ভর্তি হয়েছি শুধু অ্যালামনাইদের নেটওয়ার্কের কথা ভেবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্প খাতের পেশাজীবী ও উদ্যোক্তারা জড়িত। অনেক সময় তাঁরা আমাদের সঙ্গে কথা বলতে আসেন। আবার অনেক করপোরেট ম‍্যানেজারদেরও আমরা শিক্ষক হিসেবে পাই। এই সুযোগগুলোই কাজে লাগাতে চেয়েছি।’

আরও পড়ুন