অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ ঘুরে হার্ভার্ডের পথে ড্যাফোডিলের এই শিক্ষক
ছাত্রাবস্থা থেকেই অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, হার্ভার্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সুনাম শুনে মনে উঁকি দিত, ‘ইশ্! কোনোভাবে যদি ওসব ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি যাওয়া যেত!’ দীর্ঘদিনের এই লালিত স্বপ্নই সফল হয়েছে। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত ইয়ারবুক অব ইন্টারন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ল জার্নালের সম্পাদকীয় বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের অধ্যাপক ও সহযোগী ডিন কুদরাত-ই-খুদা। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি সূত্রে জানা গেল, বিভিন্ন বিষয়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত জার্নালের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। এসব জার্নালের কয়েকটির সম্পাদকীয় বোর্ডে ও উপদেষ্টা পর্ষদে বাংলাদেশ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন করে শিক্ষক আছেন।
নানা জার্নালে নানা গবেষণা
কুদরাত-ই-খুদা জানালেন, শিক্ষকতার শুরু থেকেই তিনি পরিবেশ আইন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি), সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে অর্ধশতাধিক গবেষণা করেছেন। কিছু গবেষণা অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ ও ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির জার্নালে প্রকাশ পেয়েছে। এ ছাড়া স্প্রিঞ্জার, সেজ, টেইলর অ্যান্ড ফ্র্যান্সিস, রাউটলেজ, থমসন রয়টার্সের মতো প্রসিদ্ধ প্রকাশনীর জার্নালেও স্থান পেয়েছে তাঁর কাজ। এসবই তাঁকে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির জার্নালের সম্পাদকীয় বোর্ডে জায়গা করে দিয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
গত জুনে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির আইন অনুষদের উদ্যোগে ‘লিগ্যাল ফিলোসফি’ নিয়ে আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন তিনি। একই বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পেশাদার ফেলোশিপে অংশ নেওয়ার সুযোগ পান। ২০২০-২১ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব গ্লোবাল হিউম্যান মুভমেন্টের সহযোগী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এই গবেষক।
কী নিয়ে কাজ
কুদরাত-ই-খুদা মূলত পরিবেশগত নানা সমস্যা ও সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে গবেষণা করেন। পরিবেশবিষয়ক গবেষণার মধ্যে আছে ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, নদীদূষণ, মাটিদূষণ, ই-বর্জ্য, মেডিকেল বর্জ্য, পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের ওপর ইটভাটা ও প্লাস্টিকের নেতিবাচক প্রভাব, পরিবেশ ও মানবাধিকারের মধ্যে আন্তসম্পর্ক। দেশে সাইবার নিরাপত্তার বাস্তব অবস্থা, এ-সংক্রান্ত আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংঘটিত সাইবার অপরাধ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের নানা প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায়, এসব নিয়েও তিনি কাজ করেছেন।
এত সব কাজের মধ্যে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে করা একটি গবেষণাকে এগিয়ে রাখলেন এই গবেষক। টেইলর অ্যান্ড ফ্রান্সিস প্রকাশনীর কোজেন্ট সোশ্যাল সায়েন্সেস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রটি এখন পর্যন্ত ৫৪ হাজার ৩৯১ বার পড়া হয়েছে। এটি ওই জার্নালের সর্বাধিক পঠিত ১০ গবেষণাপত্রের একটি।
জেদ থেকে যাত্রা
স্নাতক-স্নাতকোত্তরে গবেষণা–সংক্রান্ত কোনো কোর্স কুদরাত-ই-খুদার পাঠ্যসূচিতে ছিল না। ফলে পিএইচডির শুরুর দিকে গবেষণা কী, কীভাবে করতে হয় ইত্যাদি বুঝে উঠতেই অনেক বেগ পেতে হয়েছে। তা ছাড়া গবেষণা বাবদ বাজেট স্বল্পতা, পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়ার মতো চ্যালেঞ্জ তো আছেই।
কথা প্রসঙ্গে জীবনের একটা গল্প শোনালেন কুদরাত-ই-খুদা। সবে তখন পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হয়েছেন। একদিন সমাজকর্ম নিয়ে পাস করা এক বন্ধু এলেন ডরমিটরিতে। সেই বন্ধুর একটি গবেষণা আইবিএস জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে, সেটিই ঘুরে ঘুরে সবাইকে দেখাচ্ছিলেন তিনি। একপর্যায়ে কুদরাত-ই-খুদাও হাত বাড়ান জার্নালটি দেখবেন বলে। বন্ধু তখন কিছুটা তিরস্কারের স্বরেই বলেছিলেন, ‘তোরা আইনে পড়েছিস। গবেষণাপত্রের কী বুঝবি?’ কুদরাত-ই-খুদা বলেন, ‘সেদিন থেকে গবেষণাকে আমি সিরিয়াসলি নিয়েছিলাম। আমার মধ্যে জেদ তৈরি হয়েছিল।’
জানিয়ে রাখি, এ ঘটনার মাত্র ছয় মাসের মধ্যে সেই আইবিএস জার্নালেই কুদরাত-ই-খুদার একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। সবার আগে সেই বন্ধুকেই সেটা দেখিয়েছিলেন তিনি।
এবার হার্ভার্ড
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ল স্কুল আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেলেও কোভিড–১৯ পরিস্থিতির কারণে সেবার যাওয়া হয়নি। অনলাইনে অংশ নিয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়েছিলেন কুদরাত-ই-খুদা। তবে সেই দুঃখও এবার ঘুচতে চলেছে। এ বছর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও একটি আয়োজনে আমন্ত্রণ পেয়েছেন তিনি।
৪২ বছরের জীবনে আইনের এই শিক্ষকের অর্জন কম নয়। জুনিয়র স্কলারশিপ থেকে শুরু করে পেয়েছেন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি ফেলোশিপ, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ফেলোশিপ, আইবিএস ফেলোশিপ, আইএএফ ফেলোশিপ (জার্মানি), ডিআইইউ বেস্ট রিাসর্চ অ্যাওয়ার্ড, গ্লোবাল পিচ অ্যাওয়ার্ডসহ দেশ-বিদেশের নানা সম্মাননা ও পুরস্কার। বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের আইন বিষয়ের জন্য দেশ থেকে যে তিন বিশেষজ্ঞ নির্বাচিত হয়েছেন, সেখানেও আছেন কুদরাত-ই-খুদা। পাশাপাশি তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডেকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিজিটাল সোসাইটি প্রজেক্টে কান্ট্রি ডিরেক্টর, মালয়েশিয়ার আইএনটিআই ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও থাইল্যান্ডের সিনাওয়াত্রা ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করছেন। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যুক্ত আছেন ফিলিপাইনের লাইসিয়াম অব দ্য ফিলিপিনস ইউনিভার্সিটি এবং ভারতের চণ্ডীগড় ইউনিভার্সিটিতে।
কানাডা, জার্মানি, সৌদি আরব, ভারত, তুরস্কসহ নানা দেশ থেকে প্রকাশিত ১২টি পিয়ার রিভিউড জার্নালের সম্পাদকীয় বোর্ডের সদস্য কুদরাত-ই-খুদা বলেন, ‘সব কটি অর্জনই আমার কাছে বিশেষ।’ নানা দেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গবেষণাপ্রবন্ধ উপস্থাপনের পাশাপাশি সেমিনার ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। অনেকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। তবে জার্মানির ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি ফর লিডারশিপ থেকে ওপেন সোসাইটি ও লিবারালিজমের ওপর সেমিনারে অংশগ্রহণসহ সেখান থেকে ফেলোশিপ সম্পন্ন করার অভিজ্ঞতাকে তিনি একটি মাইলফলক বলে মানেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক এই গবেষক তরুণদের উদ্দেশে বলেন, ‘সময় অপচয় না করে বাস্তবধর্মী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে। সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী দক্ষ ও যোগ্য হয়ে উঠতে হবে।’ প্রায়োগিক গবেষণার প্রতি মনোযোগী হওয়ারও আহ্বান জানান তিনি।