সাইফুল ইসলামের জমানো শত শত ট্রেনের টিকিটে মিশে আছে রেলওয়ের ইতিহাস
ট্রেনের শত শত টিকিট জমিয়েছেন সাইফুল ইসলাম। এই সংগ্রাহকের টিকিটের রাজ্যে ঢুঁ মেরেছেন সজীব মিয়া
সাইফুল ইসলামের ধানমন্ডির বাসায় ঢুকেই থতমত খেতে হলো। সোফার ওপর অ্যালবামবন্দী বিভিন্ন ধরনের স্ট্যাম্প আর টেবিলে পুরোনো সব নথি। ড্রয়িংরুমজুড়ে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে নানা জিনিস। মনে হচ্ছিল, দলিল–দস্তাবেজের মহাফেজখানায় ঢুকে পড়েছি। চেয়ারে বসতে বলে সত্তর ছুঁই ছুঁই মানুষটা জানালেন, আমরা আসব বলেই একটু গুছিয়ে নিয়েছেন তিনি। তাঁর নানা রকম সংগ্রহ থেকে শুধু ট্রেনের টিকিটগুলোই সামনে রেখেছেন। আমরা অবশ্য সেই আলামত ভালোমতোই টের পেলাম রুমের শোকেস, আলমারি আর ট্রাংক দেখে!
সাইফুল ইসলামের বেড়ে ওঠা বাগেরহাটে। সেখানকার সরকারি পিসি (প্রফুল্লচন্দ্র) কলেজে পড়াশোনা করে ঢাকায় থিতু হয়েছেন চার দশক। একসময় ঠিকাদারি ব্যবসা করতেন। ডাকটিকিট সংগ্রহের শখ ছিল। তা থেকেই ১৯৮৯ সালের দিকে নথিপত্র সংগ্রহের নেশা পেয়ে বসে।
দেশ-বিদেশের সংগ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে।
চানখাঁরপুল আর মতিঝিলের পুরোনো কাগজের দোকানগুলো একসময় সাইফুল ইসলামের নিয়মিত গন্তব্য হয়ে ওঠে। সাইফুল ইসলামের ভাষায়, ‘আমার সংগ্রহের ৯৯ পারসেন্ট জিনিসপত্র ভাঙারির দোকান থেকে পেয়েছি। এমনও সময় গেছে, দিনের পর দিন এসব দোকানে পড়ে থেকেছি। কাগজের স্তূপ থেকে খুঁজে নিয়েছি দুর্লভ অনেক কিছু।’
বছর কয়েকের মধ্যেই দোকানিদের সঙ্গে সাইফুল ইসলামের সখ্য হয়ে যায়। কোনো কিছু সংগ্রহযোগ্য মনে হলে দোকানিরাই আলাদা করে রেখে দিতেন। এভাবেই ১৯৯৫ সাল থেকে ট্রেনের টিকিট সংগ্রহ শুরু করেন। পুরোনো কাগজের দোকান ছাড়াও বিভিন্ন সময় স্টেশনে গিয়ে গিয়েও ট্রেনের টিকিট সংগ্রহ করেছেন সাইফুল ইসলাম। তাঁর সংগৃহীত শত শত টিকিটে মিশে আছে এই অঞ্চলের রেলওয়ের ইতিহাস।
১৯৫৩ সালের টিকিট
কার্ড টিকিটটির সবার ওপরে ছোট করে লেখা—‘ই বি রেলওয়ে’ বা ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে। সম্পূর্ণ ইংরেজিতে লেখা টিকিটে শুধু হাতে লেখা হয়েছে যাত্রার তারিখ ও সিট নম্বর। ১৯৫৩ সালের ২৪ জুলাইয়ের টিকিট এটি। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী ট্রেনে প্রথম শ্রেণির ভাড়া ৮০ রুপি। এটি সাইফুল ইসলামের সংগ্রহের সবচেয়ে পুরোনো টিকিট। তাঁর সংগ্রহে আরও একটি টিকিট পাওয়া গেল ১৯৬৩ সালের। তত দিনে ই বি রেলওয়ে নাম বদলে হয়েছে পি ই রেলওয়ে বা পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে।
ফেরি পারাপার
গাইবান্ধার তিস্তামুখ ঘাট ও জামালপুরের বাহাদুরাবাদে নৌপথ চালুর মাধ্যমে ব্রিটিশ আমলেই স্থাপিত হয় ঢাকা-দিনাজপুর রেল যোগাযোগ। ১৯৯০ সালে তিস্তামুখ ঘাটটি বালাসিতে স্থানান্তর হলে বালাসি-বাহাদুরাবাদ রুটের মাধ্যমে একইভাবে রেল যোগাযোগব্যবস্থা চালু ছিল। তৎকালীন বালাসি ঘাটে রেলওয়ের অন্তত ৩০টি নানা ধরনের নৌযান ছিল। ১৯৯৪ সালের ১৯ এপ্রিল তিস্তা এক্সপ্রেসের একটি টিকিট সাইফুল ইসলামের সংগ্রহে আছে। এই টিকিটে কোচ ও আসন নম্বর হাতে লেখা। তখন গাইবান্ধা পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ভাড়া ছিল ৩২৫ টাকা। এই রুটের দূরত্ব ৩৪৬ কিলোমিটার। সকাল আটটায় ঢাকা থেকে ছেড়ে যেত তিস্তা এক্সপ্রেস। এখনো দেওয়ানগঞ্জ পর্যন্ত চলাচল করে তিস্তা এক্সপ্রেস। তবে ২০০০ সাল থেকে বালাসি-বাহাদুরাবাদ রুটে রেলের ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
টিকিটের বিবর্তন
সাইফুল ইসলামের সংগ্রহ পাকিস্তান আমল থেকে এ পর্যন্ত ট্রেনের টিকিটের বিবর্তন ধরে রেখেছে। একসময়ের একটুকরা কার্ড টিকিট বাংলাদেশ রেলওয়ের সময় হয়ে গেল তিন পৃষ্ঠা, দেখতে এখনকার দূরপাল্লার বাসের টিকিটের মতো। যাতে আবার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনও প্রচার করা হতো। এরপর হাতে লেখা টিকিট থেকে একেবারে প্রযুক্তিনির্ভর ছাপা টিকিট। প্ল্যাটফর্ম টিকিট, ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরীক্ষকের বাড়তি ভাড়ার টিকিট, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ এবং জয়দেবপুর-ঢাকা রুটে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চলাচলকারী রেলের টিকিট, কমিউটার ট্রেনের টিকিট যেমন আছে, তেমনি সাইফুল ইসলামের সংগ্রহে আছে দেশের পুরোনো জংশন থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়া ট্রেনের টিকিট, বন্ধ বা নাম পরিবর্তন হয়ে গেছে এমন ট্রেনের টিকিট, বন্ধ হয়ে যাওয়া স্টেশন থেকে ইস্যু করা টিকিট।
শতবর্ষ আগের আর্থিক বিবরণী
খুব আগ্রহ নিয়ে নিজের সংগ্রহ দেখাচ্ছিলেন সাইফুল ইসলাম। একপর্যায়ে আলমারির ড্রয়ার খুলে কয়েক পৃষ্ঠার একটি নথি বের করে হাতে দিলেন। বললেন, টিকিটের পাশাপাশি রেলওয়ে–সংক্রান্ত নানা দলিলও তাঁর সংগ্রহে আছে। তারই একটি খুলনা-বাগেরহাট রেলওয়ে কোম্পানি লিমিটেডের শতবর্ষ আগের এই আর্থিক বিবরণী। নথিটির সঙ্গে টিকিটের সম্পর্ক না থাকলেও আছে পূর্ববঙ্গের রেলওয়ে ইতিহাসের যোগ। বাগেরহাটের এক ব্যক্তির কাছে থেকে এটি সংগ্রহ করেছেন তিনি।
নথিটির তথ্য থেকে জানা গেল, ১৯২৫ সালের ১৯ অক্টোবর বার্ষিক সাধারণ সভায় এই আর্থিক বিবরণী উপস্থাপন করা হয়। এতে খুলনা-বাগেরহাট রেলপথের তিন অর্থবছরের আয়ের হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, এই পথে ১৯২৪-২৫ সালে ৪ লাখ ৪৪ হাজার ২৮৬ জন যাত্রী ও ৩৯ হাজার ৬৫২ মণ মালামাল পরিবাহিত হয়েছে। এতে আয় হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ১০১ রুপি। আর্থিক বিবরণীটি তৈরি করেছিল ভারতের মুম্বাইয়ের (তৎকালীন বোম্বে) অডিট প্রতিষ্ঠান মেসার্স রুস্তমজি এন. মেহতা অ্যান্ড কোং।
খুলনা-বাগেরহাট ন্যারোগেজ লাইনে কোচ ও মালগাড়ি চলাচল শুরু হয়েছিল ১৯১৮ সালে। তার আগে দুই বছর নির্মাণকাজ চলেছে। দেশের মূল রেল নেটওয়ার্ক থেকে আলাদা রেলপথটি ১৯৯৮ সালে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।