সুফিয়া কামালের ঘরোয়া হেঁশেল

সুফিয়া কামাল

প্রায় তিন দশক আগে সুফিয়া কামালের সস্নেহ প্রশ্রয়ে বেশ কয়েক দিন ধরে ৯০ মিনিটের দুটো ক্যাসেটে তাঁর রান্নার গল্প রেকর্ড করতে পেরেছিলাম। ১৯৯৬ সালের মার্চ-এপ্রিলের সেই দিনগুলোতে তিনি তখন অসুস্থ। বয়স ৮৫ বছর ছুঁই ছুঁই।

ঢাকায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় লেকের কাছে গাছপালায় ঘেরা তাঁর ‘সাঁঝের মায়া’ বাড়িটি তখন দোতলা। নিচতলায় পেছন দিকের একটা ঘরে তিনি বিছানায় শুয়ে থাকতেন। খোলা দরজা দিয়ে পেছনের একচিলতে চাতালটা দেখা যেত। পাখিদের কিচিরমিচির শোনা যেত।

আমাদের কথা হতো থেমে থেমে, অনেকটা সময় ধরে। শুধু যে রান্নার তরিকা জেনেছি, তা তো নয়! গত শতকের প্রথমভাগে বরিশালের শায়েস্তাবাদে নানাবাড়ির নবাব পরিবারে বড় হয়ে ওঠা থেকে শুরু করে তাঁর দেখা সময়ে নানা বিত্তের মানুষের খাওয়াদাওয়ার কথা শুনেছি।

আরও শুনেছি অভাবের সেকাল-একালের কথা। প্রায় প্রতিবার ঘুরেফিরে তিনি বলতেন, চাল-ডাল-মাছ-মাংসের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। শাকপাতা, নদী-পুকুরের মাছ বিনা পয়সায় জোটানোর মতো সুযোগও আর নেই।

বলতেন, এখন রান্নার কথা বলতে তাঁর বড় দুঃখ লাগে। এই দিকটি হয়তো ঈদের আবহে বেমানান। কিন্তু এই অনুভবের কথা বাদ দিলে কবি, প্রতিবাদী, দরদি মানুষটির রন্ধন-কথকতার বয়ান ন্যায্য হবে না।

সুফিয়া কামালের নিজের জীবন এবং রান্নাবান্নাও ছোটবেলায় দেখা প্রাচুর্য আর ভোজনবিলাসে আটকে থাকেনি। আর তাঁর পরিবার? সেটা হয়ে উঠেছিল চেনা-অচেনা সব মানুষকে নিয়ে।

প্রথম আলোর ২০০২ সালের ঈদসংখ্যা ম্যাগাজিনে কবির বলা দামি দামি রান্নার কথা লিখেছিলাম। এবার যেগুলোর কথা লিখছি, সেগুলোর বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত গণ্ডিতে চলনসই রান্না।

বহু কসরত করে প্রাচীন ক্যাসেট দুটোর কথাবার্তা অনেকটাই উদ্ধার করা গেছে। কয়েক দিন ধরে তা শুনছি। তাঁর কণ্ঠস্বরের মায়া আবার আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। মনে পড়ছে প্রতিবার বিদায় নেওয়ার সময় তাঁর হাতের ছোঁয়া আর আশীর্বাদের কথা, ‘মান-ইজ্জতের সাথে থেকো।’

বিছানায় পড়ার আগপর্যন্ত হাজারো কাজের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি ঘরের রান্না করেছেন। একবার ২০২০ সালে তাঁর বড় ছেলে শাহেদ কামালকে দেখতে গেলে কথায় কথায় তিনি বলেছিলেন, ছোটবেলায় কোথাও দাওয়াত থাকলে মন খারাপ হতো। কারণ? সেবেলা যে ঘরের রান্না খাওয়া হবে না!

তাহলে চলুন, সেসব রান্নার কথা বলি। শুধু রান্নার প্রণালি বললে সুফিয়া কামালের কথকতার অনবদ্য সুরটা হারিয়ে যাবে। তা ছাড়া সেভাবে মাপজোখ করে তিনি রান্নার তরিকা বলেননি। তাই একটু গুছিয়ে-গাছিয়ে তাঁর বয়ানেই বলি। সেটা আপনাকে সৃজনশীল হতে সাহায্য করবে। তাঁর গলা শোনাতে পারলে আরও ভালো হতো।

নিরামিষের রকমফের

‘যত রকম তরকারি আছে, সব একসাথে ছোট ছোট করে কুটে নিই। একটু বেশি করে তেল চড়িয়ে তার মধ্যে একটা শুকনা মরিচ আর একটা তেজপাতা ফেলে দিই। আর কোনো ফোড়ন-টোড়ন দিই না।

‘তারপর তরকারিগুলো সব দিলাম। নুন দিলাম। একটু হলদি, ধনেবাটা, জিরাবাটা, আদাবাটা রসুনবাটা, জিরার গুঁড়া—সব দিয়ে ব্যস ঢেকে দেও। ওর মধ্যে পানি দেয় না। আস্তে দমে দমে নিরামিষটা গললে গোলমরিচ দিয়ে নামিয়ে নিই। ইচ্ছা করলে গরম পানির ছিটা দিয়ে দিয়ে কষাতে হয়। এটা আমাদের স্পেশাল রান্না। মসলা কষিয়ে রাঁধে না।’

দমদমাদম আলু ও একটি নিরামিষ: আলুর দম তো সবাই রাঁধে। তাঁর রান্নাটা একটু অন্য রকম।

‘আলু সেদ্ধ করে ছোট ছোট করে কেটে রেখে দিই। বেশি করে পেঁয়াজ বেরেস্তা করি। একটু হলদি, একটু মরিচ দিয়ে তেলের মধ্যে খুব নাড়তে নাড়তে একদম ভাজা ভাজা করি। সেদ্ধ আলু ওর মধ্যে দিয়ে দিই। খেয়ে নিই। একটু ঝাল ঝাল হয়।’

টক-মিষ্টি নিরামিষামিষ: এই তরিকাটি একের ভেতরে দুই অথবা আরও বেশি।

‘অনেক মানুষ হলে তো অনেক লাগে। ধরো, চারটা আলু আর কয়েক টুকরা কুমড়া। থাকলে বেগুন আর বড় মুখিকচু। ফালি ফালি করে কাটা। মিষ্টিকুমড়া যেমন ভাজি না? ও রকম চ্যাপটা কাটবে।’

আলু, মুখিকচু, বেগুন—সব চ্যাপটা করে কেটে নুন-হলুদ মাখিয়ে তেলে অল্প ভেজে উঠিয়ে রাখতে হবে। টুকরোগুলো যেন না ভাঙে।

‘তারপরে তেলের মধ্যে অল্প একটু আদা, জিরা, ধনে, একটু মরিচ, হলুদ, পেঁয়াজ, রসুন—সব বাটা—দিয়ে মসলাটা কষিয়ে ভাজাগুলো দেয়। তারপর অল্প একটু হাতধোয়া পানি দিতে পারে। একটু তেঁতুলগোলা করে রাখে। তেলের ওপর আসতে নিলে ওতে একটু চিনি দিয়ে গোলাটা দিয়ে দেয়। দমে দেয়, হয়ে আসে।

‘পেঁয়াজবাটা একটু বেশি, ঝোল ঝোল হবে তো! মাখা মাখা হবে। একটু রসুন বেশি লাগে। অল্প একটু ধনেবাটা; না দিলেও হয়।

‘এগুলো ভেজে ইলিশ মাছ কিংবা রুই মাছ দিয়েও রাঁধা যায়। নিরামিষ খায়, মাছ দিয়েও খায়। আবার কেউ কেউ ওর মধ্যে বড়ি ভেজে গুঁড়া করে দেয়। কিন্তু আমরা দিই না। আমরা একটু টক দিয়ে রাঁধি। টক-মিষ্টি হয়।’

প্রিয় ইলিশ

সুফিয়া কামালের সবচেয়ে প্রিয় খাবার ছিল ইলিশ মাছ, ‘সে সেদ্ধ হোক, ভাজা হোক, রান্না হোক, সবচেয়ে ভালো ইলিশ মাছ। ইলিশ মাছ সেদ্ধ করেও খাই। ভাজা খাই, পাতুরি খাই, রান্না খাই, ঝোল খাই।’

এখানে পাঁচটি পদ দিচ্ছি, যেগুলোর প্রথমটিতেই কবি ছোটবেলায় ফিরে গিয়েছিলেন।

জেলেদের ঝোল: ‘আমাদের বরিশালের রান্না। মাঝিরা যে রাঁধত না? ওটা বড় মজা। নৌকায় থাকতাম বর্ষার দিনে। টাটকা টাটকা মাছ ধরত। ওরা করত কি, পেঁয়াজ, হলদি, মরিচ একসাথে করে পিষত একদম। পিষে তারপর পানি দিয়ে, একটু তেল দিয়ে চড়িয়ে দিত চুলায়। তো ওইটা টগবগ টগবগ ফুটত। মাছগুলো ওর মধ্যে ছেড়ে দিত। আমরা ওদের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে খেতাম। খুব মজা লাগত খেতে। একদম টাটকা মাছ তো।’

এর আগে মাছের দাম প্রসঙ্গে সুফিয়া কামাল বলেছিলেন, তখন একটা (বড়) ইলিশের দাম ছিল চার আনা, ‘আমাদের ওখানে বলে হালি; এক টাকায় এক হালি মাছ পাওয়া যেত।’

সাদা সালুন: ‘খালি পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ দিয়ে তেলের মধ্যে একদম সাদা রান্না। বেশি করে পেঁয়াজ। একটা মাছের মধ্যে এক পোয়া পেঁয়াজ কেটে একদম মাখিয়ে-টাখিয়ে চড়িয়ে দিতাম তেলের মধ্যে। আগে তো শর্ষের তেল আমরা জ্বাল দিতাম না, মাখিয়ে দিতাম। এখন তেলটা একটু ফুটিয়ে নিই। নয়তো খাওয়া যায় না। তেলটা গরম করে ওর মধ্যে পেঁয়াজ, মাছ, নুন-টুন একসাথে দিয়ে দমে দিলে গলে যাবে। তেলের ওপর আসবে, আর (তখন) খালি কাঁচা মরিচ।

‘তেঁতুল-টেতুল একটু দেয় টক হওয়ার জন্য। দুই টুকরা তেঁতুল বা আমের দিনে কাঁচা আম দুই টুকরা দিলে।’ কামরাঙা বা আনারসও দেওয়া যায়। মাছ এক কেজির বড় হলে পেঁয়াজ একটু বাড়াতে পারেন।

সেদ্ধ ইলিশ: ‘খালি নুন আর পানি দিয়ে সেদ্ধ। ওই ঝোলমতো থাকে, আমরা খাই। ওর মধ্যে পোড়া মরিচ দিয়ে, লেবুর রস দিয়ে তারপরে খাই।’ এটায় কোনো মসলা দেবেন না।

শিমের বিচি দিয়ে ইলিশ: ‘আজকাল তো খুব বিচি পাওয়া যায়। ইলিশ মাছে আদা-রসুন দিই না আমরা। হলদি, মরিচ, পেঁয়াজ পিষে মসলাটা কষিয়ে মাছ দিলে, শিমের বিচি দিলে। সেটা গলে যায়, একটু ঝোল ঝোল থাকে। বড় ভালো হয়। এখন তো ইলিশ মাছ পাওয়া যায় না।’

সুফিয়া কামাল বলেছিলেন, একইভাবে আলু, শিম, ফুলকপি, গাজর ইত্যাদি দিয়ে ইলিশ মাছ রান্না করা যায়। আর শিমের বিচি দিয়ে চিংড়ি, মুরগি, গরুর গোশত—সবই তিনি রাঁধেন।

আস্ত ইলিশের কাবাব: ‘আস্ত মাছটা দুপাশ থেকে কেটে নিই। মাথাসুদ্ধ–ল্যাজাসুদ্ধ কাঁটা আস্ত থাকে। এটা তোমাকে দেখাতে পারলে বুঝতে পারতে, বললে অতটা বুঝবে না। মাছটা যখন কাটবে, তার অন্য কিছু ফেলবে না। খালি আঁশ ফেলে দুদিকের মাছটা আস্তে করে বের করে নিতে হবে।

‘মাছটা–কাঁটাটা সব সেদ্ধ করতে হয়। কিন্তু তার আগেই কাটতে হয়। নয়তো কাঁটা ভেঙে যাবে। কাঁটাটা সেদ্ধ করতে বড় হাঁড়ি লাগে। মাথাটা ডুবিয়ে ভালো করে সেদ্ধ করতে হবে। নইলে মাছের গন্ধ হবে তো! সেদ্ধ করে আস্তে উঠিয়ে থালার ওপরে সমান করে পেতে ঢেকে রেখে দেবে।

‘মাছটা একটু নুন আর আদা দিয়ে সেদ্ধ দিলে। আদা না-ও দিতে পারো। মাছের পানিটা শুকিয়ে নিতে হবে। সেদ্ধ করে নিয়ে এক এক করে সমস্ত কাঁটাগুলা বেছে ওর মধ্যে একটু আদা, একটু রসুন দেবে। বেশি না, কাবাব বলেই দেওয়া হয়। তারপর খুব অল্প একটু ঘিয়ের মধ্যে বেরেস্তা করলে। মাছটা ওর মধ্যে দিয়ে নাড়াচাড়া করে ভুনলে। ভুনে উঠিয়ে সেটারে ঠান্ডা করলে।

‘ওর মধ্যে একটু করে পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা কিংবা পুদিনাপাতা কেটে দিয়ে মাখিয়ে-টাখিয়ে (রেখে দেওয়া মাথা-কাঁটার ওপর) মাছের আকারে সাজাবে। গোলমরিচের গুঁড়া দিতে পারো, পনির—যা ইচ্ছা তা-ই দিতে পারো। তারপর ময়দা কিংবা আটা একটু ভেজে লাল করে মাছের ওপর আস্তে আস্তে করে বিছিয়ে দিতে হবে (বেশি দিলে গ্যাদগ্যাদা হয়ে যাবে)। বিছিয়ে সেটার ওপর আমি হাত দিয়ে নকশা করে দিই। আগে তো আমরা রুপালি তবক দিয়ে নকশা করতাম। আঁশের মতো লাগত। আজকাল তবক-টবক পাওয়া যায় না।’

দুই পাতায় পাতুরি

পাতুরি

কথোপকথনে জমিদারদের খানাদানার কথা ফিরে ফিরে আসে, ‘শায়েস্তাবাদের কথার শেষ নাই তো! তারা সেদ্ধ খেত, ভাজা খেত, ফ্রাই খেত, কী না খেত! এক বেলা একটা খাবে, আরেক বেলা আরেকটা। ছোট মাছও তো আমরা খেতাম। ছোট মাছ আর পাতুরি!’

পাতুরির গল্পটা সুফিয়া কামাল শুরু করেছিলেন আক্ষেপের সুরে, ‘আজকাল তো সে কলাপাতাও নাই, কদুপাতাও নাই, আর সে কাঠের চুলাও নাই।’ তাঁর পাতুরিতে তিনটাই জরুরি উপকরণ, তবে শেষেরটা ছাড়াও আপনি করতে পারবেন।

‘চিংড়ি মাছে, ইলিশ মাছে—সবেতে পাতুরি খেতাম। নারকেল দিয়ে, শর্ষেবাটা দিয়ে। বরিশালের মানুষ তো সবেতে নারকেল খায়। একদম টাটকা কদুপাতা বেশি লাগবে। শর্ষেবাটার মধ্যে কাটা পেয়াঁজ, কাঁচা মরিচ, একটু শুকনা মরিচ আর হলদি—এই দিয়ে মাছটা মাখালাম। অল্প একটু তেল দিয়ে মাখিয়ে তারপর কলাপাতার ওপরে কদুপাতা বিছালাম। মাছটা পেতে দিয়ে তার ওপরে আবার কদুপাতা দিয়ে আবার কলাপাতা দিলাম। দিয়ে জড়িয়ে তাওয়ার ওপরে সেঁকতে দিলাম।

‘এখন তো কাঠকয়লা নাই যে ওপরে কাঠকয়লা দেবে; যদি পারো উল্টিয়ে দিলে তাওয়ার মধ্যে। আমাদের তো কাঠ দিয়ে রান্না হতো, ওই আগুনেরটা দিলেই পাতুরি হয়ে যেত। নানান রকম!’

সুযোগ থাকলে কলাপাতার মোড়কের ওপর ছেনি দিয়ে ঢেকে তার ওপরে কাঠকয়লা দিতে পারেন।

দাওয়াতের দস্তরখান ও মাকুতি-সমাচার

আগের জমানায় দাওয়াতের খানাপিনা আর রীতি-রেওয়াজের সূত্র ধরে মাকুতির খোঁজ পেয়েছিলাম। আগে শুনুন দাওয়াতের টুকরো কথা।

‘পরোটা হতো, কোরমা হতো, বিরিয়ানি হতো কিংবা সাদা পোলাও। আখনি পোলাও একটা হতো, সেটা আজকাল কেউ রাঁধে না। আজকাল সব বিরিয়ানিই রাঁধে।...বাচ্চাকাচ্চাদের তো আলাদা খাইয়ে দেওয়া হতো। মুরুব্বিরা দস্তরখান পেতে বসত চারদিকে, কিংবা টেবিল-চেয়ারে।’

তাঁদের হাত ধোয়ানোর জন্য চিলমচি-বদনা ছিল।

‘প্রথম তো হয় কাবাব, নয় কাটলেট, নয়তো চপ—মাছের হোক গোশতের হোক—একটা থাকবেই। সাথে পনির, চাটনি, পুদিনাপাতা—এসব দিয়ে সালাদের মতো একটা আলাদা প্লেটে দিত। পরোটা-কোরমা থাকত। বিরিয়ানির সাথে একটা ঝাল সালুন। কিংবা ধরো কোফতা দিত।

‘কেউ হয়তো নিরামিষ খেলো। তার জন্য নিরামিষ থাকল, কাঁচকলার কাবাব থাকল। খাওয়ার শেষে মিষ্টিটা দিতেই হতো, অবশ্য অবশ্য। হয় ফিরনি, নয়তো সেমাই। নয়তো হালুয়া, নয়তো মাকুতি। রসগোল্লা, পানতুয়া তখন আমাদের মধ্যে অতটা খাওয়া হতো না। দুধের ক্ষীর, ক্ষীরশা কিংবা মিঠা টুকরা বানানো হতো। বেশির ভাগই ফিরনি আর জরদা দেওয়া হতো।’

সুফিয়া কামালের মাকুতি: ‘তোমাকে ওটা আমি শিখিয়ে দিই। মাকুতিটা একদম সবচেয়ে সহজ। ধরো, এক পোয়া ময়দায় এক সের পানি দিয়ে ফেটে ভিজিয়ে রাখলে। আমরা তো আগে রাত্তিরে ভিজিয়ে রাখতাম, পরের দিন রাঁধতাম। যত ভেজাবে, তত ভালো হবে।

‘ওতে কিশমিশ আর গরমমসলা লাগে। অল্প একটু ঘি চড়িয়ে ওর মধ্যে কিশমিশগুলো দিয়ে উঠিয়ে রাখলে—ঘিয়ের খুশবু হয় তো! তারপর গরমমসলা দিয়ে ময়দার গোলাটা ওর মধ্যে দিলে। এক মিনিট না থেমে খুব নাড়তে নাড়তে যখন ঘন হয়ে আসে, তখন ওর মধ্যে কিশমিশ দিয়ে দেবে। যেমন ঘন সাবুদানা রাঁধলে হয় না? থকথকে থাকবে আরকি। তারপর চিনি দেবে। এইটাই বলি মাকুতি।

‘এক পোয়া ময়দার মধ্যে তুমি এক সের, দেড় সের পানি—যত পানি দেবে, অত ভালো হবে। আবার ওটা যত জ্বাল দেবে, তত ভালো। আমি তো বসে বসে এক ঘণ্টা ধরে জ্বাল দিতাম। বেশি ঘি দিলে খাওয়া যাবে না। বাগার দেয় যে রকম, ও রকম হালকা ঘি। হালকা মিষ্টি।’

শেষের শেষ কথা

এই কথকতায় আস্ত খাসির রোস্ট আর কই মাছের স্ট্যুর মতো আরও কিছু খাবারের কথা আর অনেক গল্প আছে। সেগুলো তোলা থাকল। আপাতত এই পদগুলো দিয়ে আপনার রান্নায় কবির ছোঁয়া লাগুক—এই আশা করি।

দমদমাদম আলু

আলুর দম

উপকরণ

বড় আলু ৪টি, তেল আধা কাপ, পেঁয়াজ ১ কাপ, হলুদ আধা চা–চামচ, মরিচ ১ চা–চামচ, লবণ ১ চা–চামচ।

প্রণালি

আলু সেদ্ধ করে ছোট ছোট করে কেটে রেখে দিতে হবে। তেলে পেঁয়াজও ভেজে বেরেস্তা করে রাখতে হবে। একটু হলুদ, একটু মরিচ ও লবণ দিয়ে প্রথমে তেলে কষাতে হবে। ওর মধ্যে দিতে হবে সেদ্ধ আলু। তাতে সামান্য পানি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। একটু ভাজা–ভাজা ঝাল–ঝাল হবে।

টক-মিষ্টি নিরামিষামিষ

উপকরণ

আলু ৪টি, কুমড়া ২ কাপ, বেগুন ২ কাপ, কচুমুখি ২ কাপ, তেল আধা কাপ, আদাকুচি আধা চা–চামচ, আস্ত জিরা আধা চা–চামচ, পেঁয়াজকুচি ১ কাপ, রসুনবাটা ১ চা–চামচ, হলুদ আধা চা–চামচ, মরিচবাটা আধা চা–চামচ, তেঁতুলের ক্বাথ ১ টেবিল চামচ, শুকনা মরিচ ৩টি, পরিমাণমতো লবণ।

প্রণালি

কুমড়া, আলু, কচুমুখি, বেগুন—সব চ্যাপটা করে কেটে লবণ-হলুদ মাখিয়ে তেলে অল্প ভেজে উঠিয়ে রাখতে হবে। টুকরোগুলো যেন না ভাঙে। তারপর তেলের মধ্যে অল্প একটু আদাকুচি, শুকনা মরিচ ও জিরার ফোড়ন দিতে হবে। তারপর পেঁয়াজকুচি দিয়ে একটু ভেজে সব বাটা মসলা তাতে ঢালতে হবে। এতে পরিমাণমতো লবণ দিতে হবে। এরপর মসলা কষিয়ে তাতে ভাজা সবজিগুলো দিয়ে দিতে হবে। এতে অল্প একটু হাতধোয়া পানি দেওয়া যেতে পারে। তেঁতুলের ক্বাথে চিনি মিশিয়ে রাখতে হবে। তেলের ওপরে উঠে এলে তেঁতুলের গোলা দিতে হবে। এরপর দমে রাখতে হবে ১৫ মিনিট। একটু ঝোল–ঝোল রেখে নামাতে হবে।

জেলেদের ঝোল

উপকরণ

ইলিশ ১টি, শর্ষের তেল আধা কাপ, পেঁয়াজবাটা ১ কাপ, হলুদবাটা আধা চা–চামচ, মরিচবাটা ১ চা–চামচ, লবণ ১ চা–চামচ।

প্রণালি

পেঁয়াজবাটা, হলুদ, মরিচ, লবণ ও শর্ষের তেল চটকে মাছের টুকরাগুলোর সঙ্গে ভালোভাবে মাখিয়ে রাখতে হবে। একটা কড়াইয়ে ৪ কাপ পানি দিয়ে ফোটাতে হবে। পানি টগবগ করে ফুটতে শুরু করলে তাতে মাখা মাছ দিতে হবে। এরপর ৫ মিনিট এ অবস্থায় রেখে চুলার আঁচ কমিয়ে দিতে হবে। এবার কড়াই ঢেকে রাখতে হবে ৩০ মিনিট। মাঝখানে একবার মাছ উল্টে দিতে হবে।

ইলিশের সাদা সালুন

ইলিশ মাছ

উপকরণ

সোয়া কেজির ইলিশ ১টি, শর্ষের তেল ১ কাপ, কালিজিরা ১ চিমটি, পেঁয়াজকুচি ২ কাপ, কাঁচা মরিচ ১০–১২টি, তেঁতুলের ক্বাথ ৪ টেবিল চামচ, পানি ১ কাপ, চিনি ৬ চা–চামচ, লবণ পরিমাণমতো।

প্রণালি

একটা চ্যাপটা ফ্রাইপ্যানে তেল গরম করে তাতে কালিজিরার ফোড়ন দিয়ে পেঁয়াজ দিতে হবে। পেঁয়াজ সামান্য নরম হয়ে এলে তেঁতুলের ক্বাথ, চিনি ও লবণ পানিতে গুলে ভাজা পেঁয়াজে ঢালতে হবে। টক–মিষ্টিটা একটু চেখে স্বাদ অনুযায়ী কমবেশি করা যায়। পানি ফুটে উঠলে মাছ বিছিয়ে আঁচ কমিয়ে ঢেকে দিতে হবে। ১৫ মিনিট পর মাছ উল্টে ঢেকে আরও ১৫ মিনিট কম আঁচে রাঁধতে হবে। তেল উঠে এলে নামাতে হবে।

চিংড়ির দুই পাতায় পাতুরি

উপকরণ

গলদা চিংড়ি ১০টি (কেজিতে ১৫টি চিংড়ি ওঠে এমন আকারের), বড় লাউপাতা ৫টি, শর্ষেবাটা আধা কাপ (বাটার সময় ২ কোয়া রসুন আর ২টি কাঁচা মরিচও দিতে হবে), নারকেলবাটা আধা কাপ, পেঁয়াজকুচি ১ কাপ, মরিচবাটা আধা চা–চামচ, হলুদবাটা আধা চা–চামচ, শর্ষের তেল ১/৪ কাপ, লবণ ১ চা–চামচ, কলাপাতা ভাপ দেওয়ার জন্য।

প্রণালি

লাউপাতার শক্ত আঁশটা ছাড়িয়ে লবণপানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে ১ ঘণ্টা। বাকি সব উপকরণ মাছের সঙ্গে মেখে রাখতে হবে। লাউপাতা চিপে বিছিয়ে তাতে ২টি চিংড়ি দিয়ে ভালোভাবে মুড়ে দিতে হবে। একটা ফ্রাইপ্যানে সামান্য পানি দিয়ে তাতে কলাপাতায় তেল লাগিয়ে বিছিয়ে দিতে হবে। এভাবে পুটুলির মতো সাজানো হলে সেগুলো কলাপাতায় ঢেকে তার ওপর ঢাকনা দিয়ে আধঘণ্টা কম আঁচে চুলায় রাখতে হবে। সুযোগ থাকলে কলাপাতার মোড়কের ওপরটা ভালোভাবে ঢেকে তার ওপরে জ্বলন্ত কাঠকয়লা দিতে পারেন।

মাকুতি

মিষ্টান্ন

উপকরণ

ময়দা ১ কাপ, পানি ৪ কাপ, ঘি আধা কাপ, কিশমিশ ১ টেবিল চামচ, আস্ত এলাচি ২টা, দারুচিনি ১টি, তেজপাতা ১টি, চিনি ১ কাপ।

প্রণালি

ময়দায় পানি দিয়ে ফেটে ভিজিয়ে রাখতে হবে। এক রাত ভিজিয়ে রাখতে পারলে ভালো। কড়াইয়ে ঘি দিয়ে তাতে কিশমিশ ভেজে তুলে রাখতে হবে। তারপর সেই ঘিয়ে ময়দার গোলাটা গরমমসলাসহ দিয়ে একটুও না থেমে নেড়ে যেতে হবে। নাড়তে নাড়তে যখন সেটা ঘন হয়ে আসবে, তখন তাতে কিশমিশ দিতে দেবে। তারপর দিতে হবে চিনি। ঘি ছেড়ে দিলে নামিয়ে ফেলতে হবে।