আমাকে একা ফেলে চলে গেল দুই বন্ধু: টনি ডায়েসের স্মৃতিচারণা
৮ জুন কানাডার স্থানীয় সময় রোববার বিকেলে এক দুর্ঘটনায় মারা যান দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ হিল রাকিব ও তাঁর বন্ধু বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পাইলট ক্যাপ্টেন মো. সাইফুজ্জামান। লেকে নৌকা চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান এই দুজন। এই দুজনের কাছের বন্ধু ছিলেন টনি ডায়েস। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বেড়ে ওঠা এই দুই বন্ধুকে নিয়ে লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এই অভিনয়শিল্পী।
আমার জীবনে সত্যিকারের বন্ধুত্ব ছোটবেলাতেই হয়েছে, যখন আমাদের বয়স ছিল ১০ বছর। কোনো বন্ধু ছিল আমার প্রতিবেশী, একই এলাকায় বেড়ে উঠেছি। কোনো বন্ধুর সঙ্গে স্কুলে পরিচয়, কোনো বন্ধুর সঙ্গে কলেজে। আমাদের বাবা-মায়েদের মধ্যেও বন্ধুত্ব ছিল। এই স্কুল-কলেজের বন্ধুগুলোই পরে আমার জীবনে বন্ধুর চেয়ে আরও বড় কিছু হয়ে ওঠে। আমাদের ৪০ জনের মতো বন্ধুর যে গ্রুপ, সেটার শুরু সেই আদমজী স্কুল আর শাহিন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে। আমাদের বেশির ভাগেরই ক্যান্টনমেন্টে বেড়ে ওঠা। বিশাল সেই বন্ধু দলের মধ্যে ক্ষুদ্র যে দল, সেখানে আমার সঙ্গে ছিল দুই বন্ধু আব্দুল্লাহ হিল রাকিব ও সাইফুজ্জামান। রাকিব ছিল আমার প্রতিবেশী। সাইফুজ্জামানের সঙ্গে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় একসঙ্গে বেড়ে ওঠা। বন্ধুত্বের সেই সীমা পেরিয়ে কবে তারা যেন আমার ভাইয়ের জায়গা দখল করে নেয়।
আশির দশকে স্কুলজীবনে একসঙ্গে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়িয়েছি। রাকিব, গুড্ডু (সাইফুজ্জামান) এবং আমি সেই কলেজজীবন থেকে বিভিন্ন জায়গায় একসঙ্গে ঘুরতে বেড়িয়েছি। কখনো নেপাল, কখনো ভুটান, কলকাতা, দার্জিলিং বা শিলং। আমাদের তিন বন্ধুর একসঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর কত স্মৃতি। উচ্চমাধ্যমিকের পরে ১৯৮৯ সালের দিকে বন্ধুদের মধ্যে কেউ পায়ে হেঁটে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গেছে, কেউ সাইকেল চালিয়ে দেশের একেক প্রান্তে চলে গেছে। অজপাড়াগাঁয়ে গিয়ে সন্তানদের স্কুল-কলেজে পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করার কাজও করেছে।
আমাদের আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে একটা পুকুর ছিল, যার ওপরে একটা ব্রিজের মতো ছিল। সেই ব্রিজে আমরা প্রতিদিন বিকেলে আড্ডা দিতাম। যে যার মতো করে সময় বের করে বিকেলে এখানে চলে আসত। কলেজ পাস করার পরও আমরা বিকেলবেলা এখানে আড্ডা দিতাম। অনেক বছর আগে আমরা শুধু নিয়মিত দেখা করা আর আড্ডা দেওয়ার জন্য একটা ডিসকাশন ক্লাব বানাই। যেখানে নিজের কাজের শেষে সবাই একত্র হয়ে আড্ডা জমাতাম। বনানীতে আমাদের স্থপতি বন্ধু পলাশের অফিসে এই জায়গাটা করেছিলাম আমরা। আমি যখন দেশে ছিলাম, শুটিংয়ের পরে সব সময় সেখানেই চলে যেতাম। বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে আমরা বন্ধুরা সব সময় চেষ্টা করেছি, কোনো না কোনোভাবে মানুষের উপকারে আসতে। হয়তো আমরা সেসবের প্রচার করিনি, একদম নিজেদের মতো করে থাকতে চেয়েছি আমরা।
কলেজের পর কেউ আর্মিতে গেল, কেউ এয়ারফোর্সে, কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বুয়েটে ভর্তি হলো। পরে আমাদের বিয়ে হলো, সন্তান হলো, আমাদের ছেলেমেয়েদের কেউ কেউ বিদেশে পড়তে গেল।
রাকিব বিজিএমইএর গত কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিল। বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরে তাঁর বিশাল অবদান। অত্যন্ত অমায়িক, ভদ্র একটি ছেলে। সব সময় মানুষের উপকার করে গেছে। দেশে হোক বা বিদেশে বন্ধুদের যে কারও কোনো বিপদ-আপদ বা চিকিৎসায় এগিয়ে এসেছে। আরএনজি সেক্টরের প্রায় প্রতিটি মানুষই রাকিবকে ভালোবাসত। এমন পরোপকারী একজন মানুষকে কেউ ভালো না বেসে পারে!
যে যেখানেই ছড়িয়ে পড়ুক আমরা সব সময় একসঙ্গে থাকতে চেয়েছি। আমরা চাইতাম আমৃত্যু একসঙ্গে থাকব।
আমাদের ৪০ জনের যে বিশাল বন্ধু গ্রুপ, সবাইকে একসঙ্গে রাখতে টিম গ্রুপ তৈরি করে রাকিব, সেটাকে একসঙ্গে ধরে রাখতেও তার অবদান ছিল বেশি। চাকরি হোক বা ব্যবসা সবাই যেন কাছাকাছি থাকতে পারি—এই ছিল ওর উদ্দেশ্য। আমাদের জীবন যাতে একসঙ্গে কাটে, সেটাই চাইত রাকিব। পরে তা-ই হয়েছে। তার কোম্পানিতে, বিভিন্ন সিস্টার কনসার্ন টিমের দায়িত্ব দিয়েছে একেকজন বন্ধুকে। আমাকেও এমনই একটি প্রতিষ্ঠানে সে যুক্ত করে। বলে, ‘দোস্ত তুই টুয়েলভের ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটটা হ্যান্ডল করবি। টুয়েলভের সঙ্গে তোকে থাকতে হবে।’ এভাবেই আমি ‘টুয়েলভ ক্লদিংয়ের’ সঙ্গে জড়িত হই।
সাইফুজ্জামান এয়ারফোর্স অফিসার ছিল। পরে বিমানের পাইলট। ঢাকা-টরন্টো ফ্লাইটটার কয়েকজন পাইলটের একজন। আর সাইফুজ্জামান ছিল খুবই সুশৃঙ্খল একজন পাইলট। তার রেকর্ড দেখলেই এটা বোঝা যায়। প্রতিটি ফ্লাইট সে দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করে।
আমরা সব সময় খুব বেড়াতে পছন্দ করতাম। প্রকৃতির সঙ্গে থাকতে পছন্দ করতাম। রাকিব ও গুড্ডুর মেয়ে কানাডায় কলেজে পড়তে এল। আর সেই সুবাদে অনেক ছুটিতেই তিন পরিবার মিলে কানাডা বা আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে বেরিয়ে পড়তাম। গত বছরেরও এই সময়ে আমরা তিন পরিবার কানাডার বিভিন্ন লেকে ঘুরে বেড়িয়েছি। একসঙ্গে থেকেছি, আনন্দ করেছি। কিন্তু এবার আমার দুই বন্ধু রাকিব ও গুড্ডু একত্র হলো। ফ্লাইট চালিয়ে এল গুড্ডু, রাকিব তার কাছেই ছিল। দুজনের অনেক ছবি দেখলাম, ককপিটে বসে গল্প করছে। ওরা দুজনে কানাডায় একসঙ্গে রইল, ব্যস্ততার কারণে এবার আমার আর আসা হলো না। আমি নিউইয়র্কে রয়ে গেলাম। দুই বন্ধু অন্টারিও প্রদেশের স্টারজিয়ন লেকে ক্যানুতে (সরু লম্বা ছোট্ট নৌযান) চড়ে ভ্রমণ করতে গিয়েছিল। ৮ জুন হঠাৎ ক্যানু দুর্ঘটনায় একসঙ্গে মারা যায়। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো সব ঠিক থাকলে আমার প্রাণের দুই বন্ধু আবার একই ফ্লাইটে দেশে ফিরে যাচ্ছে বৃহস্পতিবার, তবে কফিনে করে।
আমি যখন শুটিং করতাম, ওরা ফ্রি থাকলে আমার শুটিং স্পটে চলে আসত। আমাকে নানাভাবে উৎসাহ দিত। আমার মিডিয়া জগতের সহকর্মীরা সব সময় বলত, টনি ভাই আপনার বন্ধুভাগ্য অনেক ভালো। এমন দারুণ প্রাণোচ্ছল একদল বন্ধু আপনার আছে, দেখলেই ভালো লাগে। আমাদের এই ধারা মেনে আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যেও দারুণ বন্ধুত্ব। সব মিলে আমাদের বিশাল একটা পরিবার। বন্ধুদের নিয়ে আমি আজীবন গর্ব করেছি। আমাদের মধ্যে ভালোবাসা আর সহযোগিতার যে স্মৃতি জমা হয়েছে, সেসব নিয়ে হয়তো বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে হবে। আমাদের চাওয়া ছিল, সব সময় একসঙ্গে থাকব। আজীবন একসঙ্গে থাকার যে প্রত্যয় আমরা বাল্যকালে নিয়েছিলাম, সেটাই যদি সত্যি হবে তাহলে আমাকে একা ফেলে ওরা কেন একসঙ্গে পরপারে পাড়ি জমাল! কথা তো ছিল তিনজন একসঙ্গে বাঁচব।