বই পড়ে যে আরাম, সেটা আর কিসে আছে?

এ বছর সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন ফরাসি লেখক আনি এরনো। ৬ অক্টোবর পুরস্কার ঘোষণার সময় রয়্যাল সুইডিশ একাডেমির পক্ষ থেকে বলা হয়, ৮২ বছর বয়সী আনি এরনোকে নোবেল দেওয়া হয়েছে তাঁর ৪০ বছরের ‘আপসহীন’ লেখার জন্য, যেখানে জেন্ডার, ভাষা ও শ্রেণিগত বিপুল বৈষম্যের শিকার হওয়া জীবনকে তিনি তুলে ধরেছেন। ‘কেন পড়ব?’ শিরোনামের একটি নিবন্ধে নোবেল বিজয়ী আনি লিখেছেন বই পড়ার প্রয়োজনীয়তার কথা। সেই নিবন্ধেরই নির্বাচিত অংশ আজ থাকল পাঠকের জন্য।

নিজের বইয়ে স্বাক্ষর করছেন আনি এর্নো।
ছবি: সংগৃহীত

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। এক কাজিন এসেছিল হাসপাতালে আমার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। বহুদিন ধরে তার সঙ্গে যোগাযোগ নেই। এত বছর পর দেখা হওয়ার সুবাদে তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম আমার বাসায়। বসার ঘরে পা রেখেই সে থমকে দাঁড়িয়েছিল। ওর চোখ আটকে গিয়েছিল দেয়াল ঢেকে ফেলা বুকশেলফের ওপর। বিস্ময় নিয়ে সে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এই সব বই তুমি পড়েছ?’ ওর কণ্ঠে অবিশ্বাস, কিছুটা ভয়ও।

‘হ্যাঁ,’ আমি বললাম, ‘মোটামুটি সবই পড়েছি।’

সে কোনো কথা না বলে এমনভাবে মাথা নাড়ল, মনে হলো, এই কৃতিত্বপূর্ণ কাজের জন্য অনেক প্রচেষ্টার প্রয়োজন। আমার এই কাজিন ১৪ বছর বয়সে পড়ালেখা ছেড়ে কাজে নেমেছিল। ওদের পরিবারে কোনো বই ছিল না। শুধু মনে পড়ে, ওদের টেবিলের ওপর একবার টারজান কমিকসটা দেখেছিলাম।

আরও পড়ুন

এরপর আরও অনেক বই আমার বসার ঘরের জায়গা দখল করেছে। কিন্তু এমন প্রশ্ন আর কেউ করেনি। আর কারও কাছে এটা বলার মতো কিছু মনে হয়নি। সবাই ধরেই নিয়েছিলেন, আমার ঘরভর্তি বই থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এমনকি আমার ধারণা, আমার ঘরে আগত অতিথি, সাংবাদিক, সমালোচক কিংবা শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ হয়তো আরও বেশি বই দেখবে বলে প্রত্যাশা করেছিলেন।

মাঝেমধ্যেই খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে আমি আমার সেই কাজিনের কথা স্মরণ করি। এটা আরও একটা ভয়ানক স্মৃতি ভুলে থাকতে সাহায্য করে। আমার বয়স তখন ১৫ থেকে ১৮-এর মাঝামাঝি। সে সময় মনে হতো, বাবা ‘কোনো কিছুর প্রতিই আগ্রহী নন’। পড়ার মধ্যে স্রেফ প্যারিস-নরম্যানডি নামের স্থানীয় পত্রিকাটাই পড়তেন বলে আমি তাঁর নিন্দা করতাম। মেয়ের এই ঔদ্ধত্য দেখেও সাধারণত বাবা খুব শান্ত থাকতেন। কঠোর গলায় বলতেন, ‘বই তোমার জন্য ভালো হতে পারে। কিন্তু আমার জীবনধারণের জন্য বইয়ের কোনো প্রয়োজন নেই।’

এসব কথা এক অসহ্য বাস্তবতার মতো আমাকে পীড়া দিত। বাবা কী বলতে চেয়েছিলেন, আমি খুব ভালোই বুঝতাম। তাঁর মতো একজন ক্যাফেমালিকের কাছে আলেক্সান্দার দ্যুমা, ফ্লবার্ট, কামু পড়ার কোনো ব্যবহারিক উদ্দেশ্য নেই। গ্রাহক সামলাতে এসবের প্রয়োজন পড়ে না। বই পড়াকে বাবা মনে করতেন, একটা ‘সাংস্কৃতিক বোঝা’। তাঁর চোখে মঞ্চনাটক, অপেরা, শীতকালীন খেলাধুলা, সবই এই ‘বোঝা’র মধ্যে পড়ে। আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটার সঙ্গে বইয়ের বিশাল জগতের কোনো সম্পর্ক থাকবে না, এটা আমি ভাবতেই পারতাম না। তাঁর আর আমার মধ্যে বই পড়াটাই হয়ে ছিল একটা পারস্পরিক ক্ষত।

বাবার কথাগুলো আমার জীবনে বারবার একটা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের মতো ফিরে ফিরে এসেছে। না, বাঁচার জন্য বই পড়তে হয় না, তবু আমি বইয়ের সঙ্গেই বেঁচেছি। আমার জীবনের অন্ধকারতম সময়েও আমি নিজেকে একজন অপাঠকের স্থানে দাঁড় করাতে পারি না। ছয় বছর বয়সে যখন পড়তে শিখেছি, এর পর থেকেই লিখিত যেকোনো শব্দ আমাকে আকৃষ্ট করে। সে সময় বই বেশ ব্যয়বহুল ছিল। যত বই-ই পড়ি না কেন, আমার কাছে যথেষ্ট মনে হতো না। স্বপ্ন দেখতাম, একদিন একটা বইয়ের দোকানে কাজ করব। শত শত বই থাকবে হাতের কাছেই। আমার খেলাধুলায়ও বই ছিল একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রায়ই নিজেকে বইয়ের কোনো না কোনো চরিত্র ভাবতাম। কখনো আমি জেন আয়ার, কখনো অলিভার টুইস্ট কিংবা ডেভিড কপারফিল্ড, জার্মান উপন্যাস থেকে উঠে আসা কোনো ‘খালি পায়ের’ মেয়ে, আরও কত কী!

বই পড়া আমাদের নিজের কাছেই ফিরিয়ে নেয়, নিজেকে পড়তে সাহায্য করে।

এ কথা স্বীকার করি যে বই পড়া এখন আর সেই জ্ঞানের ফোয়ারা হিসেবে বিবেচ্য নয়, যেমনটা আমাদের অনেকের কাছে ছিল। আর সবার মতোই এখন কোনো শব্দের অর্থ জানার প্রয়োজন হলে আমি অভিধানের কাছে না গিয়ে ইন্টারনেটের শরণাপন্ন হই। সমাজের নানা সমস্যা ও দ্বন্দ্বের খবর আমি টেলিভিশন থেকে পাই। আমি চলচ্চিত্র দেখি, তথ্যচিত্র দেখি। কিন্তু বই আমাকে একরকম ছুটি দেয়। এর মধ্যে জ্ঞান, আনন্দ, আবেগ, সব পাই। বইয়ের কি কোনো বিকল্প হয়? বই পড়ে যে আরাম, সেটা আর কিসে আছে? আপনি পাতা উল্টিয়ে একঝলক চোখ বোলাতে পারেন, শব্দের মধ্যে ডুবে যেতে পারেন, কোথাও গিয়ে একটু সময় নিয়ে পড়তে পারেন, থামতে পারেন, বইটা ফেলে রাখতে পারেন, আবার সপ্তাহখানেক পর সেই বইয়ের কাছে ফিরতে পারেন। বই পড়াকে সময়ের কোনো বাধাধরা নিয়মে ফেলা যায় না।

২০ বছর বয়সে আমি লেখালেখি শুরু করি। ওই বয়সে একজন সম্পাদকের কাছে আমার লেখা একটি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছিলাম, তিনি সেটা বাতিল করেছিলেন। মা হতাশ হয়েছিলেন, কিন্তু বাবা নন। তিনি বরং হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলেন। আমার প্রথম বইটি প্রকাশিত হওয়ার পাঁচ বছর আগে বাবা মারা যান। মাঝেমধ্যে ভাবি, অপাঠকদের বই পড়ানোর তীব্র স্পৃহাই বোধ হয় আমার লেখালেখির লক্ষ্য। (সংক্ষেপিত)

ইংরেজি থেকে অনুদিত

সূত্র: আনি এরনো ডট ওআরজি