৩৫ বছর বয়সেই ৩৬০ কোটি ডলারের মালিক তিনি

অস্ট্রেলীয় উদ্যোক্তা মেলানি পার্কিনস। জনপ্রিয় ডিজাইন টুল ‘ক্যানভা’র তিনি সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। বয়স মাত্র ৩৫ বছর। এর মধ্যেই বৈশ্বিক টেক জগতে ক্যানভাকে একটা অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি। ফোর্বসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৩.৬ বিলিয়ন (৩৬০ কোটি) ডলারের মালিক তিনি। ব্ল্যাকবার্ড ভেঞ্চারস নামের একটি অস্ট্রেলীয় বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে সম্প্রতি তরুণ উদ্যোক্তাদের সামনে বক্তৃতা করেন মেলানি। পড়ুন সেই বক্তৃতার নির্বাচিত অংশ।

মেলানি পার্কিনসছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

১০ বছর আগেও আমাদের পুরো প্রতিষ্ঠান একটা ঘরে এঁটে যেত। আমরা সবাই একসঙ্গে এক টেবিলে বসে দুপুরের খাবার খেতাম। আর এখন আমাদের অফিসে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ জন কাজ করে। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে যুক্ত হয় আরও প্রায় ৩ হাজার ৩০০ জন। একসময় যেখানে অল্প কিছু গ্রাহক আমাদের সেবাটি ব্যবহার করত, সেখানে এখন প্রতি মাসে ১০ কোটি লোক ক্যানভা ব্যবহার করে।

এই যাত্রা থেকে আমি কী শিখলাম? আজ তিনটি বিষয়ের কথা বলব। প্রথমত, স্বপ্ন দেখার গুরুত্ব। দ্বিতীয়ত, সেই স্বপ্নকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পরিণত করা। তৃতীয়ত, প্রতিষ্ঠানের মূল্যবোধ সম্পর্কে পরিষ্কার থাকা, যা যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পথ দেখাবে।

১১ থেকে ১২ বছর কিংবা তারও আগে যখন ক্যানভা নিয়ে ভাবতে শুরু করি (হায়, বুড়ো হয়ে যাচ্ছি!), সে সময়ের কথা বলতে একটু লজ্জা লাগছে। তবু ঠিক করেছি, আজ আপনাদের বলব

স্বপ্ন দেখার গুরুত্ব

পরিকল্পনা করার দুটি একেবারেই ভিন্ন পথ আছে। প্রথমটি হলো হাতের কাছে যা কিছু আছে, তা দিয়ে কিছু একটা দাঁড় করানো। ধরুন, আপনার কাছে কিছু ইট আর বালু আছে। আপনি হয়তো একটা দেয়াল বানানোর কথা ভাববেন। হোক না সেটা দেখতে বিকট!

দ্বিতীয় পথটা অনেকের কাছে শিশুতোষ মনে হতে পারে। কারণ, ছেলেবেলা পেরোনোর পর অনেকেই এই দ্বিতীয় পথে আর হাঁটেন না। সেটা হলো স্বপ্ন দেখা। অর্থাৎ ধরুন, ওই ইট আর বালু দিয়েই আপনি মেঘের ওপর একটা প্রাসাদ বানানোর স্বপ্ন দেখলেন। হয়তো সেটা অসম্ভব। কিন্তু ভবিষ্যতে সেই প্রাসাদটাই আপনি দেখতে চান।

অতএব সেই পণ্য, শিল্প বা সেবার স্বপ্নই আপনাকে দেখতে হবে, ভবিষ্যতের পৃথিবীতে আপনি যেটা চান। ভবিষ্যতের ব্যাপারে আমি খুব আশাবাদী। আমার সব সময় মনে হয়, ভবিষ্যতের মানুষ হবে আরও বিনীত, বন্ধুভাবাপন্ন, কার্যকর ও সাম্যবাদী।

১১ থেকে ১২ বছর কিংবা তারও আগে যখন ক্যানভা নিয়ে ভাবতে শুরু করি (হায়, বুড়ো হয়ে যাচ্ছি!), সে সময়ের কথা বলতে একটু লজ্জা লাগছে। তবু ঠিক করেছি, আজ আপনাদের বলব। শুরুতে নাম দিয়েছিলাম ক্যানভাস শেফ। আমরা বলতে চেয়েছিলাম, এটা এমন এক ক্যানভাস, যেখানে আপনি যা খুশি ‘রাঁধতে’ পারেন। সব উপকরণই আপনার সামনে হাজির। ধরুন, আপনি একটা ব্রোশিয়র ডিজাইন করবেন। পছন্দমতো ব্যাকগ্রাউন্ড বেছে নিন, ছবি বসান, লেখা বসান আর সব শেষে কিছু ‘টপিংস’ দিয়ে পরিবেশন করুন। আপনি যদি একজন শেফ না-ও হন, এখানে ‘রান্না করা’ একদম সহজ।

মেলানি পার্কিনস
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

আমার কাছে মনে হয়েছিল, এটা একটা দারুণ আইডিয়া। যদিও বিনিয়োগকারীদের তা মনে হয়নি। ফলে একের পর এক প্রত্যাখ্যানের মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু আপনি যদি স্বপ্নই না দেখেন, তাহলে সেই স্বপ্ন পূরণ করবেন কী করে? স্বপ্নটা যতই বোকার মতো, উচ্চাকাঙ্ক্ষী কিংবা বিব্রতকর হোক, স্বপ্ন দেখতে হবে। কখনো কখনো আপনি হয়তো আগাছার অরণ্যে হারিয়ে যাবেন। চারপাশে এত হট্টগোল থাকবে যে মনোযোগ দিতে পারবেন না। কিন্তু তবু আমি মনে করি, আপনাকে বড় করে ভাবতে হবে।

আমি যে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছি, ১০ বছর পর এর চিত্রটা কেমন হবে? ১০ বছর আগে এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। আমাদের পুরো দলের মধ্যেই এই চর্চা ছিল। ১০ বছর পরের যোগাযোগ কেমন হবে, ইন্ডাস্ট্রি কেমন হবে, ডিজাইন কেমন হবে—এসব ভেবেছি আর স্বপ্ন দেখেছি।

এমনকি আমাদের ব্যর্থতাটা কেমন হতে পারে, সেটাও আমরা ভেবেছিলাম। এটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ঝুঁকিগুলো নিয়েও কাউকে না কাউকে ভাবতে হতো।

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

যখন আপনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে পারবেন, আপনি যে স্বপ্ন দেখছেন, সেটাই হবে ভবিষ্যৎ। তখন আপনার কাজ হলো এই স্বপ্নকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পরিণত করা। ছোট কোনো লক্ষ্য ঠিক করবেন না। আপনার মই যেন এত ছোট না হয় যে আগায় উঠে ভাবতে হয়, ‘এখন তাহলে কী করব!’ আবার প্রথম ধাপটাই পেরোতে পারছেন না, মই এতটা উঁচু হলেও চলবে না। দুটোর মধ্যে সামঞ্জস্য থাকতে হবে। একদিকে যেমন আপনাকে একটা খ্যাপাটে স্বপ্ন দেখতে হবে, তেমনি ছোট ছোট ধাপে ওপরে উঠতে হবে।

ভবিষ্যতে নিজেকে আপনি কোথায় দেখতে চান? সেটাই হলো উদ্দেশ্য (মিশন)। আর আমি মনে করি, লক্ষ্য সেই উদ্দেশ্য পূরণের একেকটি ধাপ।

লক্ষ্য বিষয়টা ক্যানভার ডিএনএতে একদম শুরু থেকেই ছিল। আমরা আমাদের জন্য বড় বড় লক্ষ্য ঠিক করতাম, সেগুলো লিখে, এঁকে দেয়ালে সাঁটিয়ে রাখতাম। লক্ষ্য পূরণ হলে পার্টি করতাম। একটা উদাহরণ দিই। শুরুতে আমাদের লক্ষ্য ছিল সারা পৃথিবীর মানুষ যেন সহজে ডিজাইনের কাজ করতে পারেন, তা নিশ্চিত করা। সেটা করতে হলে তো সব ভাষাভাষী মানুষের কাছে পৌঁছানো প্রয়োজন। ২০১৩ সালে ক্যানভা চালু করার সময় এটা শুধু ইংরেজিতেই পাওয়া যেত। তখন প্রথম লক্ষ্য ঠিক করলাম, আমরা ওয়েবসাইটে স্প্যানিশ ভাষা চালু করব। পরের লক্ষ্য, ২০টি ভাষায় ক্যানভা চালু করব। পরের লক্ষ্য ১০০টি ভাষায়। এভাবে একসময় আমরা হিব্রু, আরবি, উর্দু, চীনার মতো কঠিন ভাষায়ও ক্যানভা চালু করে ফেললাম। প্রতিবছর আমাদের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এভাবে একের পর এক লক্ষ্য ঠিক করে যাচ্ছি। এখন ক্যানভায় ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহারকারীর মাতৃভাষাই ইংরেজি নয়।

মূল্যবোধ

তৃতীয় যে বিষয়ের কথা বলেছিলাম, তা হলো প্রতিষ্ঠানের মূল্যবোধ। এটার কাজ কি শুধু দেয়ালের শোভা বাড়ানো? না। যখন আমাদের প্রতিষ্ঠান ছোট ছিল, তখন সবার সঙ্গে সবার কথা হতো। সবাই জানত, আমরা কী করছি, কেন করছি। যখন আস্তে আস্তে বড় হলাম, অনেক লোক যুক্ত হলো, তখন আমাদের মূল্যবোধ ঠিক করার প্রয়োজন হলো। প্রতিদিন হাজারো সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সবাই যদি প্রতিষ্ঠানের মূল্যবোধ না জানেন, তাহলে সিদ্ধান্ত নেবেন কী করে?

অনেক কর্মশালা, আলোচনা, কাটাছেঁড়ার পর আমরা ছয়টি মূল্যবোধ নির্ধারণ করতে পেরেছি।

১. ভালোর জন্য কাজ করা

২. সব সময় সেরা হওয়ার চেষ্টা করা

৩. জটিল বিষয়কে সহজ করা

৪. অন্যকে ক্ষমতায়িত করা

৫. বড় বড় লক্ষ্য ঠিক করা এবং তা পূরণ করা

৬. ভালো মানুষ হওয়া।

ক্যানভায় একেকটা দল থেকে শুরু করে ব্যক্তিপর্যায়েও আমরা এই মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিতে পেরেছি। কেন এগুলো আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ? কারণ, আমি মনে করি, ব্যবসা মানে শুধু লাভ করা নয়; ব্যবসাই তো পরিবর্তন আনে, গ্রাহকদের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। ব্যবসাই পৃথিবীটাকে একটা চেহারা দেয়। আমি আশা করব, আপনাদের একেকটা উদ্যোগ আমাদের সেই পৃথিবীর দিকে নিয়ে যাবে, ১০ বছর পর আপনারা যেমন পৃথিবী চান।

সূত্র: অনুষ্ঠানের ভিডিও

ইংরেজি থেকে অনূদিত