৩৫ বছর ধরে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর গয়নাগাটি সংগ্রহ করে চলেছেন প্রবাল দে

৩৫ বছর ধরে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জিনিসপত্র সংগ্রহ করে চলেছেন প্রবাল দে। তাঁর সংগ্রহের বড় একটি অংশ গয়নাগাটি। চট্টগ্রামের এই সংগ্রাহকের গল্প শোনাচ্ছেন নিজাম বিশ্বাস

তখন সপ্তম কি অষ্টম শ্রেণিতে পড়েন প্রবাল দে। পত্রপত্রিকায় যুক্তরাষ্ট্রের হিপিদের খবরাখবর পড়ে তাদের পোশাক-পরিচ্ছদের প্রতি আগ্রহ জন্মাল। ১৯৬৯-৭০ সালের সেই সময়ে মাত্রই তাঁর সংগ্রাহকজীবন শুরু হয়েছে। তাই হিপিদের জিনস প্যান্ট, টি-শার্ট, লকেট দেওয়া গলার চেইন ইত্যাদি তাঁর কিশোর মনে দাগ কেটে যায়। কিন্তু চট্টগ্রামে বসে দূরদেশের হিপিদের পোশাক-পরিচ্ছদ আর অলংকার হাতে পাওয়া তো সহজ নয়। তবে তিনি হাল ছাড়লেন না। অনেক কষ্ট করে একদিন সংগ্রহও করে বসলেন হিপি পুরুষের প্যান্টের সঙ্গে লাগানো দুটি চেইন। যে চেইনের সঙ্গে হিপিরা চাবি লাগিয়ে রাখে। প্রবাল দের আনন্দ আর ধরে না। কিন্তু চেইন তো পাওয়া গেল কিন্তু অন্যান্য বস্তু পাবেন কী করে?

সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া প্রবাল তখন বিদেশ থেকে আসা পুরোনো কাপড়ের দোকানে হানা দিলেন। ধীরে ধীরে সেসব দোকান থেকে সংগ্রহ করলেন পোশাকের সঙ্গে থাকা বিভিন্ন গয়না, কোটপিন, লকেট ইত্যাদি। হিপিদের পোশাক-পরিচ্ছদ, গয়নাগাটির পাশাপাশি তাঁর সংগ্রহে ধীরে ধীরে যুক্ত হতে থাকল ধাতব মুদ্রা, অ্যান্টিকসহ বিচিত্র সব বস্তু। এভাবেই নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর গয়নার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলেন প্রবাল দে।

৩৫ বছরের সংগ্রহ

পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা। তাঁদের ভাষা, ধর্ম, সামাজিক রীতিনীতিসহ পোশাক-পরিচ্ছদ ও অলংকারেও রয়েছে নিজস্বতা। ৩৫ বছর ধরে এসব সংগ্রহ করে চলেছেন প্রবাল। তাঁর সংগ্রহের বড় একটি অংশ আবার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর গয়নাগাটি। বর্তমানে তাঁর সংগ্রহে ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের যেসব গয়না রয়েছে, তার বেশির ভাগই রুপার তৈরি। অন্যান্য ধাতুর মধ্যে আছে টিন ও তামা।

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর গয়নায় একসময় রৌপ্যমুদ্রা খুব ব্যবহৃত হতো, বিশেষ করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজা পঞ্চম ও ষষ্ঠ জর্জের আমলে প্রচলিত বিভিন্ন মুদ্রা। রৌপ্যমুদ্রার মূল্যমানের তারতম্যের ভিত্তিতে গয়নাগুলোর বাজারমূল্যেও দেখা যেত ভিন্নতা। এক রুপির মুদ্রায় গড়া গয়নার দাম ছিল বেশি। প্রবাল দের সংগ্রহে মুদ্রা দিয়ে বানানো এ রকম বেশ কয়েকটি গয়না রয়েছে।

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীরা গলায়, কানে, নাকে, হাতে, পায়ে ভিন্ন ভিন্ন গয়না পরে থাকেন। অঞ্চলভেদে একই গয়না ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচয় পেয়েছে, যেমন নারীদের গলায় পরা নেকলেস কোথাও হাঁসুলি, কোথাও আবার চাম্বেল নামে পরিচিত। কয়েকটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীতে নারীদের পাশাপাশি পুরুষদের মধ্যেও গয়না পরার চল আছে। প্রবাল দের সংগ্রহে পুরুষদের ব্যবহৃত তেমন কিছু গয়নাও আছে, মুরং পুরুষেরা এগুলো পরে থাকেন।

এসব গয়না সংগ্রহ করার জন্য বাংলাদেশের নানা প্রান্ত চষে বেড়িয়েছেন প্রবাল। তবে জন্মস্থান চট্টগ্রাম হওয়ায় একটা সুবিধা হয়েছে, হাতের কাছেই পেয়েছেন অনেক জাতিগোষ্ঠীর সান্নিধ্য। কিন্তু কেউ তো আর এমনি এমনি গলার গয়না খুলে তার হাতে গুঁজে দেবে না, তার জন্য দিতে হবে টাকা। অনেক সময় টাকার পরিমাণ হতো তার সাধ্যের বাইরে। অর্থাভাবে কিনতে না–পারা তেমন কিছু গয়নার কথা ভেবে এখনো দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি।

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর গয়না ছাড়াও এ অঞ্চলের প্রাচীন ও মধ্যযুগের ধাতব মুদ্রা সংগ্রহের নেশাও প্রবাল দের তীব্র। মুদ্রার পাশাপাশি বিভিন্ন পুরোনো বস্তু দিয়ে তাঁর চট্টগ্রামের বাসাটিকে বিশাল এক সংগ্রহশালায় পরিণত করেছেন প্রবাল, যেসব বস্তুর ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম।