বাবাকে ওরা তুলে নিয়ে গেল

সিলেটের লাক্কাতুরা চা-বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক ছিলেন সৈয়দ সিরাজুল আব্দাল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানি শাসকদের চক্ষুশূলে পরিণত হন তিনি। মে মাসের এক সকালে তাঁকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। আর কোনো দিন ফেরেননি তিনি। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন তাঁরই সন্তান অবসরপ্রাপ্ত মেজর ডা. সৈয়দ জামিল আব্দাল

বীর মক্তিযোদ্ধা শহীদ সৈয়দ সিরাজুল আব্দাল
ছবি: সৈয়দ সিরাজুল আব্দালের পরিবারের নিকট হতে সংগৃহীত

নানার শোবার ঘরে কয়েকটা জানালা। উত্তরের জানালাটা দিয়ে বাইরে তাকালে প্রথমে সারি সারি কিছু কলাগাছ দেখা যায়। তারপরই সবুজ ধানখেত। খেত যেখানে শেষ, সেখান দিয়েই চলে গেছে ঢাকা-সিলেট রেললাইন।

১৯৭১ সালের ১৪ মে। দিনটি শুক্রবার। খেতজুড়ে খেলা করছে সকালের রোদ। হঠাৎ শব্দ তুলে ইঞ্জিনসহ দুই বগির একটা রেলগাড়ি খেতের পাশে এসে থামল। বাড়ির সবার দৃষ্টি সেই রেলগাড়ির দিকে। বগি থেকে এক এক করে খাকি পোশাকের লোক নামতে থাকল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ফৌজি কায়দায় নানাবাড়ির দিকে ছুটে এল ৫০-৬০ জন সৈন্য। পুরো বাড়ি ঘিরে ফেলল তারা। তারা কেন এসেছে, বড়দের বুঝতে অসুবিধা হলো না। সিলেটে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে আমার বাবা সৈয়দ সিরাজুল আব্দাল লাক্কাতুরা চা বাগানের চা-শ্রমিকদের সংগঠিত করেছিলেন। সেই অভিযোগে ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল পাক আর্মি তাঁকে ধরে নিয়ে সিলেট জেলে পোরে। ৭ এপ্রিল মুক্তিবাহিনী জেল ভেঙে ফেললে তিনি মুক্তি পান। আমাদের সঙ্গে দেখা করতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া থানার পাল্লাকান্দি গ্রামে আসেন তিনি। কিন্তু তিনি জানতেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁকে তাড়া করে বেড়াবে কিন্তু দেশের টানে তিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন এবং অন্য কোথাও আশ্রয় নেননি।

কয়েকজন সৈনিককে নিয়ে একজন অফিসার বন্দুক উঁচিয়ে বাড়ির প্রধান বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন (পরে জেনেছি, তাঁর নাম মেজর আবদুল ওয়াহিদ মুঘল। যিনি চিহ্নিত ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীদের একজন)। মেজর পকেট থেকে বাবার একটা ছবি বের করে নানাভাইকে বললেন, ‘আব্দাল কোথায়?’ তারপর আবার বললেন, ‘আব্দালকে না পেলে তোমার বাগান জ্বালিয়ে দেব, পুরুষদের মেরে ফেলব, মেয়েদের ক্যাম্পে নিয়ে যাব।’

বাবা বাড়িতেই ছিলেন। কাউকে দেখিয়ে দিতে হলো না, নিজেই এগিয়ে এলেন। তাঁর পরনে তখন ঘরোয়া পোশাক, হাফশার্ট আর লুঙ্গি। মেজরকে বললেন, ‘আমিই আব্দাল।’ মেজর নানাভাইকে বললেন, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাবাকে নিয়ে যাবেন তাঁরা। চার-পাঁচ দিন পর ছেড়ে দেবেন।

বাবা দুই রাকাত নামাজ পড়তে চাইলেন। মেজর অনুমতি দিলেন। নামাজ আদায় করে ঘরের মাঝখানের দরজা দিয়ে বের হয়ে এলেন বাবা। ততক্ষণে তাঁর গায়ে উঠেছে ফুলহাতা স্ট্রাইপ সাদা শার্ট। লুঙ্গি আর কাঁধে একটা বড় তোয়ালে। অজানা শঙ্কায় আমার মা (সৈয়দা সাকিনা আব্দাল) তখন অঝোরে কাঁদতে শুরু করেছেন। আমরা জানালা দিয়ে দেখলাম, গ্রামের রাস্তা দিয়ে বাবাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তারা। তারপর সৈন্যরা একে একে সবাই ট্রেনে উঠল। বাবাও উঠলেন। কিছুক্ষণ পর ট্রেনটা চলতে থাকল কুলাউড়ার দিকে। একসময় চলে গেল দৃষ্টিসীমার বাইরে।

বাবা আর ফিরে আসেননি

৫২ বছর আগের সেই সকালটা আমার কাছে এখনো জ্বলজ্বল করে। মনে হয় যেন গতকালের ঘটনা।

তুলে নিয়ে যাওয়ার পর বাবাকে কোথায় রাখা হলো, কেমন আছেন তিনি—কোনোভাবেই আমরা হদিস পাচ্ছিলাম না। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগপর্যন্ত আর পাইওনি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একদিন (প্রয়াত সাংবাদিক, সিলেটের পুরোনো পত্রিকা যুগভেরীর সম্পাদক) আমিনূর রশীদ চৌধুরী চাচা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। বাবাকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন তিনি। তৎকালীন সিলেট রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুলের (বর্তমান সিলেট ক্যাডেট কলেজ) পাকিস্তানি ক্যাম্পে বন্দী অবস্থায় পাশাপাশি কক্ষে ছিলেন বাবা আর তিনি।

১৯৭১ সালের ১৯ মে বাবাকে হত্যা করা হয়। বাবার জীবনের শেষ দিনগুলোর বর্ণনা তাঁর কাছেই পেয়েছি। ১৯৭২ সালের ১ এপ্রিল যুগভেরী পত্রিকায় আমিনূর রশীদ চৌধুরী লিখেছেন, “আমি নিজেই হলাম বন্দী।...সালুটিকর বিমানবন্দরের কাছে। একটি ছোট্ট কামরায়।...হঠাৎ দেখি আব্দাল উল্টো দিকে ছোট কামরায়।...একদিন দুপুরে আব্দালকে কিছুক্ষণ তার ছোট্ট ঘরে দেখি নেই। তারপর ঘণ্টাখানেক পরে ফেরত এসে আমাকে ইশারা করে দেখালেন—ওর রক্ত নিয়েছে পাকিস্তানি জালিমদের বাঁচানোর জন্য।...১৯ মে তারিখে ওকে চোখ বেঁধে, হাত পেছন থেকে বেঁধে, নিয়ে গেছে আমাদের বন্দীখানা থেকে।”

সৈয়দ সিরাজুল আব্দালকে নিয়ে আমিন‌ূর রশীদ চৌধুরীর স্মৃতিচারণা। ১ এপ্রিল ১৯৭২ সালে যুগভেরী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এই স্মৃতিচারণা
ছবি: মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল আব্দালের পরিবারের নিকট হতে সংগৃহীত

সৌভাগ্যক্রমে আমিনূর রশীদ চৌধুরী চাচা বেঁচে ফিরেছিলেন। তাঁর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, সিলেট ক্যাডেট কলেজের পেছনে বধ্যভূমিতে বাবাকে হত্যা করা হয়। আমিনূর রশীদ চৌধুরী চাচা অনেক দিন ওই বধ্যভূমিতে গেছেন। বাবার লাশ শনাক্ত করার জন্য বধ্যভূমি থেকে বিভিন্ন জামাকাপড় ইত্যাদি কুড়িয়ে এনে এনে মাকে দেখাতেন। আমাকেও বেশ কয়েকবার ওই বধ্যভূমিতে নিয়ে গেছেন। ওখানে অনেক বড় বড় গর্ত দেখেছি। আর মানুষের হাড়, মাথার খুলি, শার্ট, টুপি, লুঙ্গি, স্যান্ডেল ও জুতা ইত্যাদি। আমার স্মৃতিতে সেগুলো আজও ভাস্বর। কিন্তু বাবার লাশ আর শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

দুজন বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল আব্দুস সালাম বীর প্রতীক এবং অধ্যাপক জিয়াউদ্দিন আহমেদ সালুটিকরের সেই বধ্যভূমি ও গণকবরকে নতুন করে সাজিয়েছেন। সেটাই এখন ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার শহীদস্মৃতি উদ্যান’। শহীদদের স্মরণে সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। আছে ৬৬ জন শহীদের স্মৃতিফলক। গত ৪ মার্চ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন আমাদের মা সৈয়দা সাকিনা আব্দাল। অনুষ্ঠানে এসেছিলেন অন্য শহীদ পরিবারের সদস্যরাও। প্রিয়জনের সান্নিধ্যে সে এক বিষাদমাখা দিন কেটেছে আমাদের।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার শহীদস্মৃতি উদ্যানে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ
ছবি: সংগৃহীত

আমার বাবা

আমার বাবা সৈয়দ সিরাজুল আব্দাল ১৯৩১ সালের ১৮ মে হবিগঞ্জের আউশপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টে চা প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে নামকরা “সিরোকো” প্রতিষ্ঠানের চাকরির সুযোগ পান। কিন্তু সেটা না নিয়েই দেশের টানে আর মায়ের ডাকে দেশে ফিরে আসেন তিনি। ১৯৫৯ সালে ডানকান ব্রাদার্সের লাক্কাতুরা চা–বাগানে সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দেন। তাঁর এই চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট চা-কর আমিনূর রশীদ চৌধুরী চাচার অবদান ছিল।

১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল ৭ বছর। ছোটবেলায় বাবাকে খুব হাসিখুশি মানুষ হিসেবেই দেখেছি। টেনিস খেলতেন, ভালো সাঁতারু ছিলেন। পরিবারের সদস্যদের কাছে শুনেছি, আইয়ুব খানের আমলে গ্রামের অনেক স্কুল-কলেজপড়ুয়াদের মিলিটারি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। সেই সুবাদে বাবার অনেকগুলো শটগান ছিল। তিনি সিলেট রাইফেল ক্লাবের মেম্বার ছিলেন। শিকার করা তাঁর একটা শখ ছিল।

ছোটবেলায় আমরা যখন মৌলভীবাজারের পদ্মাছড়া চা–বাগানে থাকতাম, বাবা তখন বনমোরগ শিকার করতেন। মায়ের কাছে শুনেছি, তিনি হাকালুকি হাওরে শিকার করতে যেতেন। আমার আরেকটা স্মৃতিতে দেখেছি, তিনি খুব সুন্দর উড়ালজাল দিয়ে মাছ ধরতে পারতেন। কয়েক বছর পরপর গাড়ি বদলাতেন বাবা, শেষে একটা ফোর্ড করটিনা গাড়ি ছিল। তিনি খুব ভ্রমণপ্রিয় ছিলেন। সেই ১৯৬৩ সালে মাকে নিয়ে ইউরোপ ট্যুরে গেছেন। আমাদের নিজে ড্রাইভ করে নিয়ে গেছেন কুষ্টিয়া, যশোর, রাজশাহী। ১৯৭০ সালে “এমভি শামস” নামক জাহাজে করে আমাদের চট্টগ্রাম থেকে করাচি নিয়ে যান।

চাকরিজীবনের কয়েক বছর পর দেখতে পান, চা–বাগানের ইংরেজি এবং উর্দুভাষী ব্যবস্থাপকেরা বাঙালি ব্যবস্থাপকদের দমিয়ে রাখছেন। পদোন্নতিতেও চরম বৈষম্য করা হচ্ছে। তিনি তখন বাঙালি ব্যবস্থাপকদের একত্র করেন। চা-বাগানের উর্দুভাষী সব পাকিস্তানি ম্যানেজারকে বেনামে বাংলা বর্ণমালার বই পাঠান। বইটির ভেতরে চিরকুটে লেখা ছিল, ‘এই দেশে থাকতে হলে বাংলা ভাষা শিখতে হবে!’ এভাবে তিনি উর্দুভাষী ব্যবস্থাপক তথা পাকিস্তানি শাসকদের চক্ষুশূলে পরিণত হন। বাবা উনসত্তরের গণ-আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, ছয় দফা আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধেও সক্রিয় ছিলেন।