অপরিচিত পরিবেশ ও ব্যক্তির সঙ্গে শিশু কথা বলে না কেন, সমাধান কী

শিশুর কথা কম বলা মানেই অটিজম নয়। অটিজম বাদে শিশু যে আরও বিভিন্ন কারণে কম কথা বলতে পারে, সেসবই জেনে রাখুন।

শিশুর মুখে প্রথম বুলি শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন মা–বাবা। শিশুর আধো আধো বোল ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে শব্দ, এরপর বাক্য। কখনো কখনো শিশুর কৌতূহলী প্রশ্নবাণে অস্থির হয়ে যান মা–বাবাসহ পরিবারের সদস্যরা। আবার উল্টোটাও হয়। অনেক শিশুই কথা বলে দেরিতে। আবার বয়স অনুযায়ী স্বাভাবিক কথা বলতে না পারা, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঠিকমতো মিশলেও বাইরের অপরিচিত কারও সঙ্গে কথা না বলার মতো সমস্যাও দেখা যায়। কোনো কোনো শিশু তো কিছু জায়গায় গিয়ে একদম ‘স্পিকটি নট’ হয়ে থাকে। এই কথা বলা শেখার বেলায় যে বিভিন্ন সমস্যা, এসবের কারণও আদতে বিভিন্ন।

শিশুর সহজভাবে নিজেকে প্রকাশ করার জন্য, কথা বলার জন্য পরিবেশকে সহজ করতে হবে
ছবি: প্রথম আলো

কেন এমন হয়

এখন বিশেষজ্ঞরা শিশুর কম কথা বলার সমস্যার পেছনে অতিরিক্ত পর্দানির্ভরতাকে কিছুটা দায়ী করছেন। পর্দার চরিত্রদের সঙ্গে শিশুরা যে সম্পর্ক স্থাপন করে, তা সাধারণত একমুখী যোগাযোগ। এর অর্থ হলো শিশুটির বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি, কথা, অনুভূতি, ক্রিয়া, প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে পর্দার চরিত্রটি পারস্পরিক ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে না। যোগাযোগ বিকাশের সময়টিতে তাই বেশি সময় টিভি বা মুঠোফোনে ব্যস্ত থাকলে শিশুর কথা বলা, ভাব প্রকাশে অস্বাভাবিকতা দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া ছোট বা একক পরিবারে শিশু কথা বলার সঙ্গী কম পায়।
মা–বাবারা চান তাঁদের শিশুসন্তান বাইরে গেলে অথবা বাসায় কেউ বেড়াতে এলে স্বাভাবিক ব্যবহার করবে, নিজেকে উৎফুল্লভাবে প্রকাশ করবে। কিন্তু অনেক শিশুই অপরিচিতদের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলতে পারে না। এতে মা–বাবা অনেক সময় রাগ করেন, দুশ্চিন্তা করেন, বিরক্ত হন, কেউ কেউ বকাঝকা করেন। এটা ভুল। কারণ, সব শিশু এক নয়।

শিশুরা সাধারণত চঞ্চল হলেও কেউ কেউ ব্যতিক্রম আছে। কোনো কোনো শিশু অন্তর্মুখী স্বভাবের হয়, কম কথা বলে। এরা হইচই কিংবা লোকসমাগমে অস্বস্তি বোধ করতে পারে। সবার সঙ্গে সবখানে সমানভাবে মিশতে পারে না বা হইচই করে গল্প করতে পারে না। এরা সাধারণত নিজেদের গণ্ডির বাইরে মিশতে পছন্দ করে না।

নতুন কোনো পরিবেশে মানিয়ে নিতে অন্যদের তুলনায় বেশি সময় নেয়। এ ধরনের শিশুর নতুন বন্ধু তৈরি হতে সময় লাগে, গল্প জমাতে সময় লাগে। তার মানে এই নয় যে শিশুটি মানসিকভাবে বা বিকাশজনিত কারণে অসুস্থ।

আবার কোনো কোনো শিশু বাসায় হয়তো কথা বলে, কিন্তু স্কুল বা অন্য কোথাও একদমই কথা বলে না। তাদের অনেক সময় বোবা কিংবা অটিজমে আক্রান্ত বলে ভুল ধারণা জন্মাতে পারে। এই সমস্যায় যদি শিশু এক মাসের বেশি ভুগে থাকে, স্কুলের পড়ালেখা, খেলাধুলা ও অন্যান্য স্বাভাবিক কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে শিশুটি ‘সিলেক্টিভ মিউটিজম’–এ ভুগছে বলে ধারণা করা যায়। সাধারণত বিভিন্ন মানসিক চাপে এ রকম হয়ে থাকে।

শিশুদের বোঝাতে হবে ধৈয্য ধরে
ছবি: প্রথম আলো

বড়দের যা করতে হবে

শিশুর সহজভাবে নিজেকে প্রকাশ করার জন্য, কথা বলার জন্য পরিবেশকে সহজ করতে হবে।

  • নতুন বা অপরিচিত পরিবেশ শিশুদের জন্য ভয়ের বা অস্বস্তির কারণ হতে পারে। তাদের কথা বলতে বা মিশতে প্রয়োজনীয় সময় দিতে হবে।

  • বাড়ির অতিথিদের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে, তা শিশুকে সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলুন।

  • শিশুরা অনুকরণপ্রিয়, তাই আপনি নিজেও বাড়ির এবং বাইরের মানুষের সঙ্গে সহজ ও সুন্দর ব্যবহার করুন।

  • শিশুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বা আন্তরিকতার সঙ্গে মিশুন।

  • কথা বলতে দেরি হলে তাদের এই সময়ে ধৈর্য ধরে উৎসাহ দিতে হবে।

  • বকাঝকা করলে, ভুল ধরতে থাকলে শিশুর আত্মবিশ্বাস আরও কমে যায়। এতে সে কথা বলতে ভয় পাবে, নিজেকে গুটিয়ে নেবে।

  • ছোটবেলা থেকেই সন্তানের সঙ্গে বেশি বেশি কথা বলার চেষ্টা করতে হবে। শিশুর চাওয়াকেও গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।

ছোটবেলা থেকেই সন্তানের সঙ্গে বেশি বেশি কথা বলার চেষ্টা করতে হবে
ছবি: প্রথম আলো
  • শিশু কোনো কারণে মানসিক চাপে আছে কি না, সেটা খেয়াল রাখুন।

  • কোনো কোনো ঘটনা শিশুমনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পরবর্তী সময়ে সে কারণে শিশু নিজেকে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারে না। তাই শিশুর মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলা সেসব বিষয় চিহ্নিত করা জরুরি।

  • শিশুর কথা বলতে বা সামাজিক পরিস্থিতিতে সাড়া দিতে খুব বেশি অসুবিধা হতে পারে।

  • শিশু অস্বাভাবিক পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ করতে পারে। অথবা কথা বলার অসুবিধার জন্য তার দৈনন্দিন জীবনে ব্যাঘাতও ঘটে।

  • এসব ক্ষেত্রে একজন শিশুবিশেষজ্ঞ বা শিশু নিউরোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।

ডা. ফারাহ দোলা, বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর