‘একবারই বাঘের সামনে পড়েছিলাম,’ বললেন বাওয়ালি রশীদ সানা

মধু সংগ্রহ করলে হয় মৌয়াল; আর বনে গোলপাতা আহরণে গেলে হয় বাওয়ালি। রশীদ সানা এক জীবন কাটিয়ে দিলেন সুন্দরবনের গোলপাতা সংগ্রহ করে। ৫ মার্চ শাকবাড়ীয়া নদীর তীরে গোলপাতাবোঝাই নৌকায় তাঁর বাওয়ালি হয়ে ওঠার গল্প শুনলেন ইমতিয়াজ উদ্দীন

বাওয়ালি রশীদ সানা
ছবি: ছুটির দিনে

সুন্দরবন লাগোয়া কয়রার মোহাম্মদ হাওলাদারের ছিল গোলপাতা আহরণের বড় নৌকা। মৌসুম এলে হাওলাদারবাড়িতে তোড়জোড় পড়ে যেত। শ্রমিক সংগ্রহ, বন বিভাগ থেকে অনুমতি নেওয়া, নৌকা মেরামত, গোলপাতা কাটার অন্যান্য সরঞ্জাম জোগাড়—কত কাজ। এই মুহাম্মদ হাওলাদারের মেয়েকেই বিয়ে করেন রশীদ সানা। সুন্দরবনসংলগ্ন ৪ নম্বর কয়রা গ্রামের এক অভাবী পরিবারে তাঁর জন্ম। লেখাপড়া শেখা হয়নি। শিশু বয়সেই শুরু হয় সংগ্রামীজীবন। সুন্দরবনে মাছ ধরা হয়ে ওঠে তাঁর পেশা।
বিয়ের পর শ্বশুরের গোলপাতা আহরণের নৌকা পরিচালনার ভার রশীদ সানার ওপর পড়ে। চার দশক আগের সেসব দিন ষাটোত্তীর্ণ মানুষটার চোখে আজও জ্বলজ্বল করে, ‘বলা যায়, আগে জেলে ও মৌয়াল ছিলাম, বিয়ের পর বাওয়ালি হয়ে গেছি। সুন্দরবনের নদীর বাঁক আর বনের ছোট ছোট খাল, খাঁড়ি ও নালা নিজের হাতের তালুর মতো চেনা। গোলপাতার মৌসুম শেষ হলে আবার মাছ ধরতে বনে আসব। সামনে মধুর চাক পেলে সেটাও কাটব।’

আরও পড়ুন

সুন্দরবনের শাকবাড়ীয়া নদীর তীরে বেঁধে রাখা রশীদ সানার বড়ো নৌকায় থরে থরে সাজানো গোলপাতা। পাশেই আরও একটি ছোট নৌকা বাঁধা। বড়ো নৌকায় বসে বাওয়ালি রশীদ সানা জানান, গোলপাতা আহরণের জন্য ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে সুন্দরবনে ঢুকেছিলেন। বড় নৌকাটি বনের সব খাল ও নদীতে ঢুকতে পারে না। এ জন্য পাশে বাঁধা ছোট নৌকাটায় করে গোলপাতা কেটে এনে বড় নৌকায় সাজিয়ে রাখতে হয়। এবার নৌকা নিয়ে বনে ঢুকতে তাঁর খরচ হয়েছে প্রায় দুই লাখ টাকা। আশা করছেন, গোলপাতা বিক্রি করে দেড় লাখ টাকার মতো লাভ থাকবে।
রশীদ সানা বলেন, ‘গোলপাতা কাটার জন্য আটজন শ্রমিক কাজ করে। তাদের কেউ শুধু গোলপাতা কেটে ফেলে রাখে। কেউ কেটে রাখা পাতা টেনে নৌকায় নেয়। আবার কেউ পাতাগুলো নৌকায় সাজিয়ে রাখে। এই আটজন শ্রমিককে এক মাসে মজুরি দিতে হবে ১ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। তার ওপর এক মাসের বাজার-সদাই ও বন বিভাগের অনুমতিপত্রের খরচ, সব মিলিয়ে দুই লাখ টাকা খরচ হয়। এরপর নৌকাভর্তি গোলপাতা লোকালয়ে আনার পর এক কাউন (১২৮০টা) গোলপাতা সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকায় বিক্রি হয়।’

আরও পড়ুন
শাকবাড়ীয়া নদীর তীরে রশীদের গোলপাতাবোঝাই নৌকা
ছবি: ছুটির দিনে

গোলপাতার ঝাড়ের মধ্যে বাঘ লুকিয়ে থাকার আশঙ্কাও থাকে। এরপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বনে এই পাতা কাটতে যান তাঁরা। ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রতিবছরই গোলপাতা কাটতে যাচ্ছেন তাঁরা। বাওয়ালি রশীদ সানা বলেন, ‘এর মধ্যে একবারই বাঘের সামনে পড়েছিলাম। গহিন বনে খালের মধ্যে আমার নৌকা বাঁধা ছিল। এমন সময় হঠাৎ বনের মধ্যে হরিণের ছোটাছুটি শুরু হয়। নীরব বন মুহূর্তেই জেগে ওঠে। বানরের দল এ-ডাল থেকে ও-ডালে লাফাতে থাকে। খালের পাড়ে তাকিয়ে দেখি, বড়ো একটি বাঘ গাছের ফাঁক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। দ্রুত নৌকা নিয়ে ওই স্থান ত্যাগ করেছিলাম।’
চাহিদা কমে যাওয়ায় কয়েক বছর ধরে গোলপাতা বিক্রি করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, জানালেন রশীদ সানা। এই পাতায় নাকি এখন আর তেমন ব্যবসা হয় না। সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতেও কষ্ট হচ্ছে। তারপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বনে গোলপাতা কাটতে এসেছেন।
 রশীদ সানা জানান, গোলপাতার গাছও তাল-নারকেলগাছের মতো বছর বছর ঝুড়তে হয়, মানে গাছের পরিণত পাতাগুলো কেটে দিতে হয়। প্রতিবছর নিয়মমাফিক গোলপাতা কাটা হলে গাছের পরিচর্যা হয় এবং পাতার সংখ্যাও বেড়ে যায়। সময়মতো গোলপাতা কাটা না হলে পাতা নষ্ট হয়ে ঝাড় ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা থাকে।