প্রযুক্তিও কেন নারী নির্যাতনের হাতিয়ার হবে

অলংকরণ: আপন জোয়ার্দার

স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে যখনই কেনাকাটার জন্য বের হন বা কোথাও বেড়াতে যান, আগেই ট্রায়াল রুমে বা হোটেল কক্ষে নিজে প্রবেশ করে সব ঠিক আছে কিনা দেখে নেন আনিসুর রহমান। এই ‘সব ঠিক’-এর ব্যাপারটি আনিসুরের জন্য বড় চিন্তার বিষয়। কারণ, স্ত্রী-সন্তানেরা যেন গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা ছবির শিকার না হন।

যুগে যুগে হয়রানি ও নির্যাতনের ধরন পাল্টালেও ভুক্তভোগীর ক্ষেত্রে নারী সব সময়ই শীর্ষে। নারীই পণ্য, নারীই নির্যাতনের হাতিয়ার। তা কাউকে ফাঁসাতে হোক কিংবা ক্ষতি করার উদ্দেশ্যেই হোক, খুঁজে খুঁজে কোনো নারীকে নির্যাতন বা হয়রানির কথাই প্রথম ‘সমাজের’ মাথায় আসে।

প্রযুক্তির যুগে নারী নির্যাতন যেন নতুন রূপ পেয়েছে। গোপনে ছবি তুলে, সম্পর্কের অবনতিতে অন্তরঙ্গ ছবি ছড়িয়ে, কৌশলে মুঠোফোন থেকে ব্যক্তিগত ছবি নিয়ে অথবা ছবি সম্পাদনা করে নারীকে হেয় করার নানা পন্থাই বের করছে অপরাধীরা।

গোপনে ভিডিও ধারণ, কৌশলে ছবি নেওয়া, অন্তরঙ্গ ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার মতো বেশ কয়েকটি ঘটনা সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী চিকিৎসার জন্য স্ত্রীকে নিয়ে রাজশাহী শহরে এসে এক হোটেলে ওঠেন। হোটেলে ঢোকার ঘণ্টাখানেক পর হোটেলের লোকজন ওই দম্পতিকে বাইরে ডেকে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন। বলা হয়, টাকা না দিলে গোপনে ধারণ করা ভিডিও অনলাইনে ছেড়ে দেওয়া হবে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পুলিশ জানায়, ওই হোটেলের বিভিন্ন কক্ষের দরজায় ছিদ্র করে হোটেলে কোনো অতিথি জুটি এলে গোপনে ভিডিও করা হতো।

এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই জানা গেল আরেক কীর্তির কথা। গাজীপুরের এক ডেলিভারিম্যান অনলাইনে অর্ডার করা পণ্য পৌঁছে দিতে গিয়ে হাতিয়ে নিতেন নারীদের ছবি। পণ্য পৌঁছানোর পর সহজে পণ্য ডেলিভারির জন্য গুগল লোকেশন যুক্ত করে দেওয়ার কথা বলে নারী ক্রেতার মুঠোফোনটি চেয়ে নিয়ে গুগল ফটো অ্যাপে যেতেন। এই অ্যাপের শেয়ারিং অপশনে গিয়ে ‘শেয়ার উইথ পার্টনার’ অংশে নিজের ব্যক্তিগত জিমেইল অ্যাকাউন্ট যুক্ত করে দিতেন। এক ভুক্তভোগীর অভিযোগে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে।

জনসমাগমস্থলে ছেলেরা হরহামেশাই মারামারিতে জড়াচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের কয়টি ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে? ঠিক একই কাজ মেয়েরা করলেই ভাইরাল।

প্রেমে বা সম্পর্কে ব্যর্থ হয়ে সঙ্গীর ছবি বা ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা এখন প্রতিনিয়তই হচ্ছে। বলিউডের বিগ বস তারকা রাখি সাওয়ান্ত সম্প্রতি তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধেই অভিযোগ তুলেছেন, তাঁর ব্যক্তিগত
মুহূর্তের ভিডিও তৈরি করে তা বিক্রি করেছেন স্বামী।

নারীকে হেয় করার মানসিকতাকে নিজেদের পুরুষত্বের প্রমাণ দেখানোর একটা উপায় বলে মনে করেন অনেক পুরুষ, জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহনাজ হুদা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নারীরা আগের চেয়ে অনেক বেশি বাইরে আসছেন, সমাজে নানা ক্ষেত্রে তাঁদের বিচরণ বেড়েছে। পাবলিক প্লেসে তাঁদের এখন অনেক বেশি চলতে হয়। কিন্তু এটাকেও ভালোভাবে নিচ্ছেন না অনেক পুরুষ। তাঁরা সুযোগ পেলেই হেনস্তা করেন।

অধ্যাপক শাহনাজ বলেন, নারীদের হেনস্তা করে বা তাঁদের ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে অনেকে নিজের পরিচিতজনদের মধ্যে বাহবা পেতে চান।
এটাকে তারা ‘পৌরুষত্বের’ পরিচায়ক বলে মনে করেন। তিনি আরও বলেন, এসবের ভয়ে তো মেয়েদের চলাচল সীমিত করে দেওয়া যাবে না; বরং সরকারের দায়িত্ব নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকে মনে করেন, পাড়ায় পাড়ায় নামসর্বস্ব অনেক হোটেলে গড়ে উঠছে। এসব হোটেল তদারকের আওতায় আনা প্রয়োজন। এ ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানে গোপনে ভিডিও বা ছবি ধারণের কোনো অভিযোগ এলে অপরাধীকে আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকেও বড় অঙ্কের জরিমানা করা প্রয়োজন। তাহলে এসব বিষয়ে প্রতিষ্ঠান কঠোর হবে।

সম্প্রতি এক অফিসে যোগ দিয়েছেন ফারিয়া আহমেদ। যতবারই অফিসের টয়লেটটি ব্যবহার করেন, ততবারই তাঁর মনে হয়, কোথাও কি কিছু আছে? ফারিয়া বলেন, ‘ট্রায়ালরুমে বা বাইরের কোনো টয়লেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবচেতন মনে একটা ভয় কাজ করে। কিন্তু কী করার। আমাদের তো চলতে হবে।’

জনসমাগমস্থলে চলাচলের ক্ষেত্রে সব সময় নিরাপত্তার চিন্তা নিয়ে চলা মুশকিল উল্লেখ করে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ বলেন, সব সময় তটস্থ হয়ে নারীকে কেন চলতে হবে?

প্রযুক্তি অনেক এগিয়েছে, জানিয়ে সুমন আহমেদ বলেন, এসব ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা কঠিন। এসব ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদাহরণ তৈরি করতে হবে। ঘটনা ঘটলে ভুক্তভোগী না লুকিয়ে যেন পদক্ষেপ নেন, সে ব্যাপারে উৎসাহ দিতে হবে। তাহলে অন্যরাও সতর্ক হবেন।