কয়লা থেকে শুরু করে চানাচুরের কারখানায়ও কাজ করেছে মা

মা দিবস উপলক্ষে মাকে নিয়ে লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী আসিফ আলী

মায়ের সঙ্গে লেখক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

আমার মায়ের জীবনে এত বৈচিত্র্য, ভাবলে নিজেও কখনো কখনো অবাক হই। ২০১০ সালে বাবা যখন আমাদের ছেড়ে চলে যায়, তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। এরপর ১৩ বছর ধরে মা সংগ্রাম করে যাচ্ছে। মা চাইলে আবার বিয়ে করতে পারত, নানাবাড়ি থেকে অনেকবার বলাও হয়েছিল, কিন্তু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সে কখনো এই সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। আমার বাবার ছিল অনেক দেনা। সব ঋণের বোঝা মায়ের ঘাড়ে এসে পড়ে। কিস্তির লোক, পাওনাদারেরা কত অসহ্য কথাই না শুনিয়েছে। বাসার জিনিসপত্র, টিনের চাল খুলে নিয়ে যেতে চাইত। মায়ের এতই ধৈর্য যে এসব তাকে দমাতে পারেনি। কিন্তু রাতে সে ঠিকই কাঁদত হাউমাউ করে। সব ঋণ মা শোধ করেছে, আবার পরিবারও চালিয়ে নিয়েছে।

আরও পড়ুন

প্রাথমিকে পড়ার সময় ঘুম থেকে উঠে পাশে মাকে পেতাম না। ভোরে উঠেই সে চলে যেত কয়লা কারখানায় কাজ করতে। আবার বিকেলে স্কুল থেকে ফিরেও মায়ের দেখা পাইনি। কিন্তু দুপুরে এক ঘণ্টার জন্য কাজের বিরতিতে এসে ঠিকই রান্না করে যেত আমাদের জন্য। মাগরিবের আজানের পর হাতে একটা পাউরুটি আর লাড্ডু নিয়ে আসত। বিকেলে তাকে কয়লা কারখানা থেকে খেতে দিত। কিন্তু মা কখনো খেত না। নিয়ে আসত আমাদের জন্য।

প্রতিদিনের কাজের জন্য দেওয়া হতো মাত্র ২৫০ টাকা। এভাবে চলছিল। কিন্তু কিছুদিন পর কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। তখন নানাবাড়ি থেকে পাওয়া একটা ছাগল বিকেলে খেতে চড়াত মা। আর শীতের হাড়কাঁপানো ঠান্ডা সকালে মানুষের খেতের মরিচ তুলে কেজিপ্রতি ৮-১০ টাকা করে পেত। অন্যের ফসল তুলে দেওয়ার কাজ করত। এতসব ঝঞ্ঝার মধ্যেও আমার পড়ালেখা কখনো থেমে যায়নি।

মানুষের বাসায় কাজ করেছে মা কত দিন। সেসব বাসায় যখন দুপুরে খেতে দিত, নিজে অল্প খেয়ে ‘বাড়িতে আমার আসিফ আছে’ বলে নিয়ে আসত মা। এসব দিয়েও যখন আর চলছে না, তখন মা কাজ নিল ডালের মিলে। বেশ ভারী কাজ। এদিকে মার এক হাত ভাঙা। সেই হাতে হাড় নেই, বদলে আছে সার্জিক্যাল রড। অতঃপর মা কাজ নেয় চানাচুর ফ্যাক্টরিতে। বেশ কিছুদিন কাজ করার পর এই কারখানাও বন্ধ হয়ে যায়।

এরপর মা পাটকলে কাজ নিতে চেয়েছিল। কিন্তু মাকে যেন কষ্ট করতে না হয়, সে জন্য আমিই তখন সবজির দোকানে কাজ শুরু করি। তবু মা বসে থাকেনি। নিজের জমানো টাকায় গরু কিনেছে। এখনো সে পাঁচটি ছাগল পালন করে যাচ্ছে। পাশাপাশি মরিচ ও ফসল তোলার কাজও করে। কোনো অসুস্থতাকে মা পাত্তা দেয়নি। প্রতি বর্ষায় যখন ঝড়ে বাড়ির চাল উড়ে গেছে, মা আমাদের আঁকড়ে ধরে রেখেছে। লুকিয়েছে চাপা কান্না। 

আজ আমি মাকে বলতে পারি, ‘তোমার সন্তান দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে মা।’ সমাজের মানুষ এখন তাঁকে সম্মান করে। এখন আর শুধু দুঃখে নয়, মা আনন্দেও কাঁদে।