ইউরোপ-আমেরিকায় নয়, ঢাকার নিকেতনে নিভৃতে তৈরি হয়েছেন এই ক্যামেরাওয়ালা

প্রতি বাংলা নববর্ষের মতো ১৪৩১ সনেও দেশের ক্রীড়া, চলচ্চিত্র, ডিজিটাল মঞ্চ, ব্যবসা, গবেষণাসহ নানা ক্ষেত্রের তরুণ প্রতিভাবানদের নিয়ে হাজির হয়েছে প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’। একঝাঁক উজ্জ্বল তরুণদের নিয়ে আজ ছাপা হয়েছে দুই পাতার এই বিশেষ আয়োজন। এখানে সিনেমাটোগ্রাফার তুহিন তমিজুল-এর গল্প শোনাচ্ছেন নির্মাতা ইকবাল হোসাইন চৌধুরী

প্রায় পুরোটা সময় ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে কাজ করেন তুহিন তমিজুল
ছবি: তুহিনের সৌজন্যে

তুহিনের হাতে বিশাল ব্যান্ডেজ। সেই হাত ফিতা দিয়ে গলায় ঝোলানো। চোখে কালো চশমা। মাথায় টুপি। 

চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের বহির্গমন গেটে আমি মোটামুটি হতভম্ব। সামনের মাসে বলী: দ্য রেসলার সিনেমার শুটিং। একটু পর আমরা রওনা হব বাঁশখালী সৈকতের পথে। লোকেশন দেখার কাজ। এখন এই হাত ভাঙা ডিপি (ডিরেক্টর অব ফটোগ্রাফি) দিয়ে আমি কী করব! তবে তুহিন মনে হয় না এসব নিয়ে ভাবিত। দূর থেকে সুন্দর করে হাসল। ব্যান্ডেজমুক্ত হাতটা দিয়ে বেশ কায়দা করে হাত মিলাল। মাইক্রোবাসে ওঠার সময়, মনে হয় আমার মনের কথা বুঝতে পেরেই বলল, ‘ভাই, সমস্যা নাই।’ 

আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের রেহানা মরিয়ম নূর-এর চেয়ে আমার বেশি প্রিয় লাইভ ফ্রম ঢাকা। রেহানা মরিয়ম নূর কান চলচ্চিত্র উৎসব মাতিয়েছে কিন্তু তাঁর প্রথম ছবি লাইভ ফ্রম ঢাকা আগেই জানান দিয়েছিল বাংলাদেশের সিনেমায় এক নতুন প্রতিভা আসছে। কী সাংঘাতিক নির্মোহ ক্যামেরার কাজ। যতবার লাইভ ফ্রম ঢাকা দেখি, বিস্ময় কাটে না। ইউরোপ-আমেরিকায় নয়, আমাদের ঢাকার নিকেতন মহল্লায় নিভৃতে তৈরি হয়েছে এমন ক্যামেরাওয়ালা!

বলী: দ্য রেসলার সিনেমার শুটিংয়ে তুহিন তমিজুল
ছবি: ইকবাল হোসাইন চৌধুরীর সৌজন্যে

লাইভ ফ্রম ঢাকার পর রেহানা মরিয়ম নূর। এই ছবিতে তুহিনের ‘হ্যান্ডহেল্ড’ ক্যামেরার সুখ্যাতি করেছে হলিউড রিপোর্টার, ভ্যারাইটি অবধি। অ্যারি অ্যালেকজা ক্যামেরা, লেন্স মিলিয়ে যথেষ্টই ভারী। সেই ক্যামেরা প্রায় পুরোটা সময় কাঁধে নিয়ে কীভাবে কাজ করলেন তুহিন! রেহানা মরিয়ম নূর-এর কান প্রদর্শনীর পর এক সাক্ষাৎকারে তুহিনের এই অসামান্য ভারবাহী ক্ষমতার কথা বিশেষভাবে বলেছিলেন সাদ। আর আয়নাবাজি, রিকশা গার্লখ্যাত অমিতাভ রেজা তো তুহিন তমিজুলের খেতাবই দিয়েছেন ‘মাস্টার অব হ্যান্ডহেল্ড’।

মাইক্রোতে যেতে যেতে তুহিনের কাছ থেকে রেহানার চিত্রধারণের অভিজ্ঞতা আবার শুনি, ‘রেহানার সেটে মনে করেন ট্রাইপড নিষিদ্ধ ছিল। ৩৪ দিনের শুটিং। পুরোটাই হ্যান্ডহেল্ড। মানে ক্যামেরা ছিল আমার হাতে বা কাঁধে।’ সাদ-তুহিন জুটির এই কাজ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সিনেমা ইতিহাসের একটা মাইলফলক। 

বিবিএ পড়তে যশোর থেকে ঢাকা এসেছিলেন তুহিন। সেটা ২০০৬ সালের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেতাবি পাঠ শেষে কোথায় চাকরিবাকরি, কোথায় কি। তুহিন চলে এলেন সিনেমার লাইনে। ‘বিবিসি সংলাপ’ দিয়ে বলতে গেলে ক্যামেরার কাজের শুরু। এরপর সিনেমার অ্যারি অ্যালেকজা ক্যামেরা পর্যন্ত আসার পথে বন্ধু সাদই ছিলেন সবচেয়ে বড় সহায়। দুজনে মিলে বিজ্ঞাপনের কাজ করেছেন অনেক। এরপর এল ২০১৫ সাল। লাইভ ফ্রম ঢাকার শুটিং। শুটিংয়ের জন্য ৭০ হাজার টাকা দিয়ে কেনা হলো একটা আস্ত গাড়ি। 

বটে? ৭০ হাজার টাকায় গাড়ি! সেই গাড়ি চলে? নাকি হর্ন ছাড়া বাকি সবকিছুই শব্দ করে?

‘অনেকটা ওরকমই। প্রায় সময় মাঝপথে বন্ধ হয়ে যেত। আমাদের টিমের দুজন মিলে ওটাকে ঠেলত। আমি বসতাম পেছনে ক্যামেরা কাঁধে,’ রহস্য খোলাসা করেন তুহিন। 

লাইভ ফ্রম ঢাকার শেষ দিকে গাড়ি ভাঙার দৃশ্য ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। মহা আক্রোশে বিক্ষুব্ধ জনতা সাজ্জাদের (মোস্তফা মন্​ওয়ার) গাড়ি ভাঙছে। চারপাশে ছিটকে পড়ছে কাচের টুকরা। এই দৃশ্য গা বাঁচিয়ে কীভাবে ধারণ করা সম্ভব? বুদ্ধি করে সারা গায়ে মোটা ছালা জড়ালেন তুহিন। এরপর ঢুকে গেলেন সেই লক্কড়ঝক্কড় গাড়িতে! 

 ২০২২–এ ফিরে আসি। বলীর শুটিং শুরু হবে। আমার প্রযোজক পিপলু আর খানের সঙ্গে প্রচুর বিষয়ে আমার দ্বিমত। তবে তুহিন তমিজুলকে লাগবে—এ ব্যাপারে আমরা চট্টগ্রাম ব্যাংক কলোনির দুই ভাই শতভাগ একমত। এখন ভাঙা হাত নিয়ে তুহিন বলছে বটে ‘সমস্যা নেই’ কিন্তু আদতেই কি সমস্যা নেই? বলীর নির্বাহী প্রযোজক তানভীর হোসেন মোটামুটি সামরিক কায়দায় ইউনিট চালান। এর কোনো সদুত্তর দেখলাম তাঁর কাছেও নেই। 

প্রথম ছবি পরিচালনা করতে যাচ্ছি। আমার জন্য বিরাট ঝুঁকি। আবার মনে হয় তুহিন তমিজুলের ক্যামেরার বিখ্যাত ‘বাস্তবতার ঝাঁকি’ আমি পাব না। শেষমেশ ভাবলাম তুহিন তমিজুলই সই। সপ্তাহ দুয়েক পর চিকিৎসকের কাছ থেকেও ছাড়পত্র মিলল। তুহিনের হাত একদম ঠিকঠাক। অতিরিক্ত সাবধানতা হিসেবে আমরা তবুও তুহিনকে ক্যামেরা কাঁধে নেওয়ার কোনো সুযোগ দিলাম না।

শুটিংয়ের প্রথম দিন। কী হয় না হয় এই নিয়ে মহা দুশ্চিন্তায় আছি। কিন্তু প্রথম সুযোগেই তুহিন বুঝিয়ে দিলেন কেন তিনি কানের লালগালিচা ঘুরে আসা ডিপি। ঘরের রোয়াকে বসে আছে মজু (নাসির উদ্দিন খান)। নিজে নিজে বকর বকর করছে কী যেন। তার অদ্ভুত খ্যাপা চোখের চাহনি ঘুরপাক খাচ্ছে চারপাশে। আশ্চর্য দক্ষতায় ক্যামেরায় সেই দৃশ্য তুলে আনলেন তুহিন। এখনো যতবার এই দৃশ্য দেখি, একটা ঘোরের মতো লাগে। আমি একা নই। বিলেতি পত্রিকা স্ক্রিন ডেইলির সমালোচক জন বেরার মতো লোকজনও উচ্চকিত প্রশংসা করেছেন বলী সিনেমায় তুহিনের অসাধারণ লেন্সিং আর প্রাকৃতিক আলোর ব্যবহারের। 

বুসান চলচ্চিত্র উৎসবের মতো বড় আসরের প্রধান পুরস্কার (নিউ কারেন্টস অ্যাওয়ার্ড) জয় শুধু নয়। বলী: দ্য রেসলার আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ তুহিন তমিজুলের মতো অসম্ভব পরিশ্রমী আর প্রতিভাধর কিছু বাংলাদেশি কলাকুশলীর জন্যও। তুহিন তমিজুল সেই যে বলেছিলেন, ‘সমস্যা নাই।’

সিনেমা তৈরির কাঁটা বিছানো পথে এই একটা কথাই তো শুনতে চাই বারবার। যত বিপদেই পড়ি, যত বড় হোঁচটই খাই, কেউ একজন যেন হাসিমুখে বলে, ‘ভাই, সমস্যা নাই।’