‘কঠিন বিষয়গুলো পাপেট দিয়ে সহজে শিশুদের শেখানো যায়’

পুতুলনাটক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেছেন ড. রশীদ হারুন। গবেষণা করতে গিয়েই শিল্পমাধ্যমটির প্রেমে পড়ে যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের এই অধ্যাপক। গড়ে তোলেন ‘বাংলাদেশ পুতুলনাট্য গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র’। বিভিন্ন বয়সী মানুষের কাছে পুতুলনাটককে জনপ্রিয় করে তুলতে কাজ করছে এ প্রতিষ্ঠান। ২১ মার্চ বিশ্ব পুতুলনাট্য দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পুতুলনাট্যশিল্পী সম্মাননা পেয়েছেন রশীদ হারুন। ১৩ এপ্রিল প্রথম আলো কার্যালয়ে এই অধ্যাপকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাসান ইমাম

বাংলাদেশের পুতুলনাট্য নিয়ে আরও বিস্তর পথ পাড়ি দিতে চান অধ্যাপক ড. রশীদ হারুন
ছবি: বাংলাদেশ পুতুলনাট্য গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্রের সৌজন্যে

প্রশ্ন :

অভিনন্দন। কীভাবে যুক্ত হলেন পুতুলনাট্যে?

সেলিম আল দীনের উৎসাহে। তিনি আমাকে এ বিষয় নিয়ে গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৯৫-৯৬ সালে আমার গবেষণার নিবন্ধন নিলেও তখন খোঁজখবর করে তাদের সম্বন্ধে কোনো তথ্য পাচ্ছিলাম না। শেষে অনেক খুঁজে একটা–দুটো করে দলের সন্ধান পেতে শুরু করি। বলা যেতে পারে, ২০০০-০৭ সময়ে বিশদে তথ্য পেয়ে গবেষণার কাজটি শেষ করলাম। আমার গবেষণা শেষ হওয়ার আগেই সেলিম স্যার চলে গেলেন। পরে আফসার আহমেদ স্যারের সঙ্গে কাজটি শেষ করি। এ সময়ে ৫০টির মতো জায়গায় পুতুলনাট্যের তথ্য পেলেও দিন শেষে সচল পেলাম ১২টির মতো দল। তাদের বেশির ভাগেরই মৌলিক গল্প নেই। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দলগুলো ছিল ব্যতিক্রম। সেখানে মিলল নানা রকম গল্পের পুতুলনাট্য।

প্রথম আলো কার্যালয়ে পুতুলনাট্য গবেষক রশীদ হারুন
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

প্রশ্ন :

সাধারণত এ শিল্পমাধ্যমকে সবাই পুতুলনাচ বলেই সম্বোধন করে। তাহলে পুতুলনাট্য...

আমার গবেষণার তথ্য, এর গঠনশৈলী, নান্দনিকতা, পরিবেশনাশৈলী সব দেখে মনে হয়েছে, এটি নাটকেরই একটি আঙ্গিক। কারণ, পুতুলনাচ বলে তো কোনো নাচ নেই। এটিকে লোকনাট্য হিসেবেই আমাদের ইতিহাসে, ঐতিহ্যে, সংস্কৃতিতে লেখা। পরিবেশনার দিক থেকে এটি যেহেতু থিয়েটার, সেদিক থেকে এটিকে পুতুলনাট্য বলাই সমীচীন। এ বিষয়ে বাংলা একাডেমি থেকে আমার যে বই বেরিয়েছে, সেটিরও নাম ‘বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাট্য’ (২০১৪)। শিল্পকলা একাডেমিতে এখন যে অনুষ্ঠান ও দিবসটি পালন করা হয়, সেটিও পুতুলনাট্য নামেই। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের পুতুলনাট্যশিল্প উন্নয়ন নীতিমালা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে, সেখানেও এটি পুতুলনাট্য।

পুতুলনাট্য কুঁজোবুড়ি
ছবি: বাংলাদেশ পুতুলনাট্য গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্রের সৌজন্যে

প্রশ্ন :

বিলীন হতে বসা এ সাংস্কৃতিক মাধ্যমটির আবার কীভাবে নবজাগরণ হলো?

একসময় পুতুলনাট্যের রমরমা বাজার থাকলেও নানা করণে সেটা বিভিন্ন সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাকিস্তান আমলে দেখা গেল, পুতুলনাট্যের যে গল্প, সেগুলো বেশির ভাগ পৌরাণিক কাহিনিনির্ভর। এ কারণে মুসলিম দর্শক কমতে থাকল। আবার বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক কারণেও কমেছে। তবে নতুন করে আবার পুতুলনাট্য ফিরছে। টিভি অনুষ্ঠান, বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, হাসপাতালেও এই পুতুলনাট্য ব্যবহার হচ্ছে। কখনো সেটা চিকিৎসা হিসেবে, কখনো বিনোদনের মাধ্যমে শিক্ষা দিতে। প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিশুদের শিক্ষাকে আনন্দময় করতে পুতুলনাট্য ব্যবহার করা হচ্ছে। জটিল রোগে ভোগা শিশুদের মানসিক শক্তি বাড়াতেও পুতুলনাট্য ব্যবহার করা হচ্ছে।

২০০৭ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে ১০টি পুতুলনাট্যের দল নিয়ে প্রথমবার একটা উৎসব করি। ২০১৩ সালে বেশ কয়টি ঘটনা পুতুলনাট্যের সুদিন ফেরাতে কাজ করে। সেবার শিল্পকলা একাডেমি ২টি পুতুলনাট্য কর্মশালার আয়োজন করে, যেখানে ৩৫ সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেন ভারতের সুদীপ গুপ্ত।

এ বছর ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক পাপেট শোতে অংশ নেয় বাংলাদেশের ১২ সদস্যের দল, যেখানে আমরা পরিবেশন করি ‘টেলস অব বাংলাদেশ’। ৪৬টি দেশের ৬০টির বেশি দলের মধ্যে আমাদের দলটি ‘বেস্ট ট্র্যাডিশনাল মিউজিক্যাল পাপেট’ পুরস্কার পায়। একই সঙ্গে আমরা নমিনেশন পেলাম ডিজাইনে (কপালি)। এখান থেকে ফেরার পর থেকে আমাদের ছেলেরা আগ্রহের সঙ্গে পুতুলনাট্য নিয়ে কাজ শুরু করে।

২০১৩ সাল থেকে নিয়মিতভাবে পুতুলনাট্য উৎসবের আয়োজন হচ্ছে, যেখানে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত গুণী শিল্পীদের সম্মানিত করার প্রচলনও শুরু হয়।

রশীদ হারুনের পুতুলনাট্য ‘কে বড়’। পরিবেশিত হয় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে
ছবি: খালেদ সরকার
আরও পড়ুন
‘গুনী পুতুলনাট্যশিল্পী’ সম্মাননা নিচ্ছেন অধ্যাপক রশীদ হারুন
ছবি: খালেদ সরকার

প্রশ্ন :

বাংলাদেশ পুতুলনাট্য গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র কবে হলো?

ওই যে বললাম, ছেলেদের মধ্যে একটা আগ্রহ তৈরি হলো। ওরা বলল, স্যার, চলেন আমরা একটা কিছু করি। এভাবেই ২০১৫ সাল থেকে সংগঠন হিসেবে পাপেট বানানোর কাজ শুরু হলো। ২০১৬ সালের ৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ পুতুলনাট্য গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্রের উদ্বোধনী প্রদর্শনী হলো শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে। সেই যাত্রার পর ১০৯টি শো হয়েছে এ পর্যন্ত। এবারও আন্তর্জাতিক পুতুলনাট্য উৎসবে আমাদের শো ছিল।

সব মিলিয়ে এখন ৩০টির মতো দল বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে। ২০১৭ সালের পর থেকে ঢাকার অনেক দল বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে পাপেট শো করছে, সমাজসচেতনতামূলক প্রোগ্রামে অংশ নিচ্ছে, বেসরকারি স্কুলগুলোও আগ্রহী হচ্ছে।

পুতুলনাট্য পরিবেশনে মৌলিক গল্প থাকা জরুরি
ছবি: খালেদ সরকার

প্রশ্ন :

পুতুলনাট্য নিয়ে সামনে কী করার ইচ্ছা?

স্কুলগুলোয় শিশুদের আনন্দময় উপায়ে শিক্ষাদানের জন্য পাপেটের জনপ্রিয়তা আরও বাড়াতে চাই। গণিত বা বিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলো শিশুদের পাপেটের মাধ্যমে সহজে বোঝানো সম্ভব। শিক্ষিত তরুণদের এ মাধ্যমে নিয়ে আসতে চাই। সেটাকে তারা যাতে পেশা হিসেবে ভাবতে পারে, সে ক্ষেত্রগুলো নিয়ে কাজ করতে চাই।