আমার দেখা সবচেয়ে সুখী দম্পতির একি হাল, পারিবারিক জীবনে কেউই কি তাহলে সুখী নয়

‘ছুটির দিনে’র আহ্বানে ভালোবাসার টক–ঝাল–মিষ্টি গল্প লিখে পাঠিয়েছেন পাঠক। কেউ লিখেছেন দুরন্ত প্রেমের গল্প, কেউবা শুনিয়েছেন দূর থেকে ভালোবেসে যাওয়ার অনুভূতি। ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের আগেই পড়ুন বাছাই এমনই একটি লেখা।

অলংকরণ: আপন জোয়ার্দার

‘সজীব, শিখাকে আমি আজই ডিভোর্স দিব, তোমার সঙ্গে সন্ধ্যায় দেখা করে সব ফাইনাল করে নেব। ওর সঙ্গে আর থাকা সম্ভব নয়।’

আনন্দের কথায় চমকে উঠি। দুই বছর যেতে না যেতেই ডিভোর্স! আমার দেখা সবচেয়ে সুখী দম্পতির একি হাল। পারিবারিক জীবনে কেউই কি তাহলে সুখী নয়।

বছরখানেক আগে ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আনন্দ-শিখার সঙ্গে যোগাযোগটাও কমে গেছে। নাইট কোচে ভোরে সুনামগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছেছি। আজই দুজনের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার কথা। কিন্তু সাতসকালে বাস থেকে নেমেই আনন্দের কথা শুনে মাথাটা বোঁ বোঁ করে উঠল।

আনন্দ ফোন রাখার পর শিখাও কল দিল। তারও একই কথা—সন্ধ্যায় দেখা করে সব সম্পর্ক শেষ করে দেবে, এভাবে নাকি হচ্ছে না আর। আইনজীবী হিসেবে ডিভোর্স করানো আমার সবচেয়ে অপছন্দের কাজ। কিন্তু আনন্দ–শিখার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এই অপছন্দের কাজটা করতেই হবে। তবু আমি দুজনকেই শান্ত থাকার পরামর্শ দিলাম। কিন্তু কেউ কথা শুনল না, একটা দিনও একসঙ্গে নাকি থাকা আর সম্ভব নয়। দুজনই মহাখালীতে সন্ধ্যা সাতটায় সব কাগজপত্র নিয়ে আমাকে হাজির হতে বলল।

ডিভোর্সের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঙ্গে নিয়ে মহাখালী সাউথ পয়েন্ট স্কুলমাঠে সন্ধ্যা সাতটায় অপেক্ষা করছি। বছর দুই আগে এই মাঠে বসেই আনন্দ শিখাকে বিয়ের সিদ্ধান্ত পাকা করেছিল। বিয়ের পর এই মাঠেই সাংসারিক নানা বিষয়ে কত গল্প হয়েছে। এই মাঠ ঘিরে আমাদের হাজারো স্মৃতি। চা–বিস্কুট আর ঝালমুড়ি খেয়ে খেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডায় কতশত রঙিন সন্ধ্যা কাটিয়েছি।

একটু পর আনন্দ–শিখা মাঠে ঢুকল। ধীরপায়ে আমার কাছে এগিয়ে এল। একটু দূরে পাকা বেঞ্চিতে বসল শিখা। আনন্দ আমার কাছে এগিয়ে আসতেই কাগজ দেখিয়ে বললাম, ‘সবকিছু গুছিয়েই এনেছি। এখানে সাইন করো, তাহলেই হবে।’

সাইন না করে কাগজগুলো নিয়ে সে মাঠের বাইরে চলে গেল। তার চোখেমুখে অদ্ভুত এক অপরাধবোধ। একটু পর তিনটা ঝালমুড়ির ঠোঙা হাতে নিয়ে আবার ফিরে আসে আনন্দ। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় বুঝতে পারি ঝালমুড়ির ঠোঙাগুলো আমার নিয়ে আসা তালাকের কাগজ!

আমি অবাক হই। আনন্দ ফিসফিস করে বলে ওঠে, ‘দুজন রিকশায় আসতে আসতে বুঝতে পেরেছি, ভুলটা আসলে আমারই হয়েছে। তুমি এই ঝালমুড়ির একটা ঠোঙা শিখাকে দিয়ে বলো যে, শিখা চলে গেলে এই জীবনে আমার আর কেউ থাকবে না, আমি নিঃস্ব হয়ে যাব। সংসার আর ভালোবাসা আসলে অনেকটা ঝালমুড়ির মতোই, একটু লবণ, একটু মরিচ, একটু ঝাল না থাকলে আসল মজাটা বোঝা যায় না, এগুলো কমবেশি হয়ে গেলেই যত সমস্যা।’

বন্ধুর দার্শনিক কথায় হো হো করে হেসে উঠি। হাসির শব্দে মাঠের অনেকে আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়। সবার দৃষ্টি উপেক্ষা করে শিখার সিক্ত চোখের সামনে গিয়ে মুড়ির ঠোঙাটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘আনন্দ তোমার জন্য ঝালমুড়ি ভালোবাসা পাঠিয়েছে।’