স্বামী এবং স্ত্রীর মধ্যে যে ধরনের আইনি সম্পর্ক থাকা উচিত

স্বামী–স্ত্রীর মধ্যে মতের অমিল হবেই, নিজেদের মধ্যেই বোঝাপড়া করে নিতে হবেছবি: প্রথম আলো (ছবিটি প্রতীতী)

সংসার নামক যৌথ জীবন সব সময় একই রকম যায় না। অনেক সময় না চাইলেও ভেঙে যায় সংসার। তাই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে কিছু আইনি বিষয় সব সময় পাকাপোক্ত করে রাখা ভালো। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরবর্তী জীবনে এসবের কোনো উপযোগিতা থাকে না, তবে কখনো কখনো পরবর্তী সময় অনেক জটিলতা থেকে রক্ষা করে এই ব্যবস্থা।

বিয়ে দিয়েই শুরু করি। সদ্য বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী নতুন জীবন সাজানো নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তবে এই আনন্দের মধ্যেও শুধু কবুল বলে বা সাত পাক ঘুরে বিয়ে করলেই হবে না, সেটার নিবন্ধনটাও করে রাখা চাই। পরবর্তী জীবনের নানা ক্ষেত্রে ‘বিবাহ সনদ’ বা নিবন্ধন আপনার কাজে লাগবে। শুধু সদ্য বিবাহিতই নয়, যেকোনো বয়সী যুগলের জন্য এটা জরুরি।

আইনে আছে, স্ত্রীর ভরণপোষণ স্বামী বহন করবেন, তাঁদের যদি সন্তান হয়, সেই সন্তান ও মায়ের ভরণপোষণ এবং যাবতীয় খরচাপাতি (আবাস, শিক্ষা, চিকিত্সা, খাদ্য) সবই আইনগতভাবে স্বামীর দেওয়ার কথা। এমনকি স্ত্রীর দেনমোহরও স্বামীকে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা মুসলিম আইনে রয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিয়ের সময় কিছু অংশ পরিশোধ করা হয়, বাকিটা রয়ে যায়। কেউ কেউ বিয়ের পর কয়েক বছরে বাকিটা শোধ করেন। তারপর স্বামী হয়তো স্ত্রীকে বলেও দেন ‘দেনমোহরের টাকাটা দিয়ে দিলাম।’ হয়তো স্ত্রী কখনো সেটা চান না, কিন্তু সেটা পরিশোধের বাধ্যবাধকতা স্বামীর আছে। তাই বলে এই নয় যে দেনমোহরের জন্য চাপাচাপি করতেই হবে এবং না দিলেই পারিবারিক আদালতে চলে যাবেন স্ত্রী। এখানেই দরকার নিজেদের মধ্যে একধরনের বোঝাপড়া। নিজেদের মধ্যে প্রেম ঠিকঠাক থাকলে বৈষয়িক বিষয়গুলো কখনো বাধা হয় না। তবে হ্যাঁ, শুনতে খারাপ লাগলেও, দেনমোহর দিলে স্ত্রীর কাছ থেকে যথাযথ উপায়ে একটা লিখিত স্বীকৃতি নিয়ে রাখা উচিত। আবার স্ত্রীর দেনমোহর নিয়ে কোনো দাবি না থাকলেও লিখিত থাকতে পারে, তাতে দোষের কিছু নেই।

নিজেদের মধ্যে প্রেম ঠিকঠাক থাকলে বৈষয়িক বিষয়গুলো কখনো বাধা হয় না।
ছবি: প্রথম আলো

স্ত্রী যদি কর্মজীবী হন, তবে তিনি নিজেও সংসারের জন্য খরচ করতেই পারেন আর সেটা তাঁরা করেও থাকেন, তবে সেখানে তাঁর আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। দ্রব্যমূল্যের এই চড়া সময়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনই ঠিক করে নিতে পারেন কে কোন খরচ বহন করবেন। তার মানে এই নয় যে স্বামী স্ত্রীর কাছে অধিকার হিসেবে খরচাপাতি দাবি করবেন। তবে চাইলে স্ত্রী সেটা পারেন। তবে ভরণপোষণ কেমন হবে, কোন খাতে কেমন খরচ হবে, তা নিজেরাই আলোচনা করে নির্ধারণ করে নিলে সহজ হয়। ভরণপোষণের পরিমাণ সাধারণত নির্ধারিত হয় স্বামীর আয়রোজগারের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে।

এরপর আসি সঞ্চয়ের বিষয়ে। দুজনের কেউ যদি ভবিষ্যতের জন্য কোনো সঞ্চয় করতে চান, যেমন সঞ্চয়পত্র, ডিপিএস বা এফডিআর কিংবা ব্যাংকের হিসাব—তাহলে কে কাকে নমিনি করবেন, তা আলোচনা করে নিতে পারেন। দুজনের যৌথ নামে হিসাব বা সঞ্চয় থাকলে নমিনি সন্তান হবে কি না কিংবা কাকে করছেন, সেটা ভেবেচিন্তে দেওয়া উচিত। কারও নামে কোনো ব্যাংকে বা অন্য কোথাও টাকাপয়সা থাকলে সে সম্পর্কে পরস্পরকে অবগত করা উচিত। কেউ যদি মারা যান, তাহলে পরিবারের বাকিরা এই সম্পদের বিষয়ে না জানলে সেটা নিয়ে জটিলতা তৈরি হতে পারে। কোনো কিছু কেনা (যেমন জমি বা ফ্ল্যাট) হলে সেটা যৌথ নামে নাকি এক নামে হবে, সেটাও নিজেরাই আলোচনা করে ঠিক করতে পারেন। স্বামী-স্ত্রীর অবর্তমানে সন্তানেরা যাতে ঠিকঠাক সম্পত্তি পায়, সেটাও আইনি প্রক্রিয়ায় গুছিয়ে রাখা জরুরি। অনেক সময় শুধু কন্যাসন্তান থাকলে ভবিষ্যতে সে কতটা পাবে, তা নিয়ে কিছু দুশ্চিন্তা কাজ করে। এ জন্য প্রয়োজনে হেবা করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। প্রয়োজনে দুজনে মিলে যাবতীয় বিষয় বুঝতে ও সমাধান করতে আইনজীবীর পরামর্শ নিতে পারেন।

এবার আসি মতের অমিল নিয়ে। অধিকাংশ তালাকেই স্বামী-স্ত্রীর বনিবনার অভাবকে দায়ী করা হয়। তালাকের নোটিশেও বেশির ভাগ সময়ে লেখা থাকে—মন ও মতের অমিল কিংবা বনিবনা হচ্ছে না। কোনো কারণে একসঙ্গে থাকাটা অসম্ভব হয়ে পড়লে সেটাও আলোচনা করে ঠিক করে নিতে পারেন। সংসার শেষ পর্যন্ত একান্তই টিকিয়ে রাখা সম্ভব না হলে কেউ কারও ওপর বিদ্বেষ না নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে পারেন। স্বামীর পুরুষত্বহীনতার কারণেও স্ত্রীকে বিচ্ছেদ চাইতে দেখা যায়। তবে এ রকম কোনো বিষয় হলে চিকিত্সকের শরণাপন্ন হয়ে চিকিত্সা করানো পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেতে পারে। বিচ্ছেদের পর কোনো দেনাপাওনা থাকলে এ বিষয়ে নিজেরা মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া ভালো, প্রয়োজনে কাছের মানুষদের সহায়তা চাইতে পারেন। বিচ্ছেদের সময় সন্তান থাকলে সে বা তারা কার কাছে কীভাবে থাকবে, তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে—এসব বিষয়ে নিজেরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, এমনকি আইনগতভাবে চুক্তি সম্পাদনও করতে পারেন। তালাকের নোটিশ কার্যকর হতে ৯০ দিন লাগে। এই সময়ের মধ্যে নিজেদের ভুল–বোঝাবুঝির অবসান হলে তালাকের নোটিশ প্রত্যাহার করে পুনরায় সংসার করতে পারেন। হুটহাট কোনো বিষয়ে বিরোধ হলেই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত নয়। আগে আপস–মীমাংসা করে ফলপ্রসূ না হলেই কেবল আইনের আশ্রয় নেওয়া উচিত। তবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, যৌতুকের জন্য অত্যাচারের মতো গুরুতর বিষয়ে তাৎক্ষণিক আইনি প্রতিকার নেওয়াই ভালো। আর যদি স্ত্রী বা স্বামী অপরজনের কাছে ফিরতে না চান, তাহলে সংসার আর টিকিয়ে রাখবেন কি না, এ বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা উচিত।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট