বজ্রপাত থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছি

হাওরে ধান কাটতে গিয়েছিলেন তিন কৃষিশ্রমিক। হঠাৎ বৃষ্টি। আশ্রয়ের খোঁজে পাশের একটা খামারের দিকে ছুট লাগালেন তাঁরা, তখনই তাঁদের মাঝে কড় কড় কড়াৎ করে পড়ল একটা বাজ। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনজন। ঘটনাস্থলেই মারা যান একজন। আহত দুজনের মধ্যে চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছেন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের কাবিল মিয়া। তাঁর কাছে ২৩ এপ্রিলের সেই রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তের গল্প শুনে এসেছেন শিমুল তরফদার

কাবিল মিয়া
ছবি: প্রথম আলো

হাইল হাওরজুড়ে এখন পাকা ধান। দু-এক দিন টানা বৃষ্টি হলেই পাহাড়ি ঢলে পানির তলে চলে যেতে পারে এই ধান। আর এমনটা যখন হয়, তখন ধান কাটার সময়টাও পর্যন্ত পাওয়া যায় না। আহা, কত দেখলাম কষ্টের ধান পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে গেল। তাই দাবদাহের মধ্যেই এবার ধান কাটার কাজ শুরু হয়ে গেছে।

আমি অবশ্য কৃষক না, জেলে। পশ্চিম শ্রীমঙ্গল এলাকার লালবাগ গ্রামের অনেক মানুষই আমার মতো। তবে এই মৌসুমে হাওরে পানি থাকে না, মাছও থাকে না। তাই অন্য পেশা বেছে নিতে হয়। দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরিতে অন্যের জমিতে এখন শ্রমিকের কাজ করি। ২৩ এপ্রিলও ধান কাটার কাজ পেয়েছিলাম। সঙ্গে ছিল গ্রামের জাহেদুর আলী আর রিয়াজ উদ্দিন। আমরা তিনজনই খুব ভোরে কাস্তে হাতে নিয়ে খেতে ধান কাটতে যাই। বেলা বাড়লে রোদের তাপে ধান কাটতে কষ্ট হয়। তাই ভোরের নরম আলোয় হাওরে ধান কাটা শুরু করি। আশপাশের খেতে আরও অনেকেই আমাদের মতো ধান কাটছিল।

সকাল ৯টা কি সাড়ে ৯টা হবে। হঠাৎই মেঘে মেঘে ছেয়ে গেল আকাশ। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়া শুরু হলো। কাটা ধানগুলো ভিজে যাওয়ার আগেই তড়িঘড়ি টমটমে তুলি। ধান নিয়ে কৃষকের বাড়ি চলে যায় টমটম। হঠাৎ বৃষ্টিও বেড়ে যায়। আমরা যে জমিতে কাজ করছিলাম, তার পাশেই একটা মাছের খামার আছে। খামারে অস্থায়ী একটা ঘরও আছে। বৃষ্টিতে না ভিজে ওই ঘরের দিকে রওনা দিই। আগে রিয়াজ, মাঝে জাহেদুর ভাই আর পেছনে আমি। দ্রুততালেই যাচ্ছিলাম। আচমকা বিকট শব্দে বাজ পড়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। কানে তালা লেগে যায়। সব কেমন যেন নীরব হয়ে যায়। সামনে চেয়ে দেখি একজনের গা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে, আরেকজন পাশে পড়ে আছে। কোনটা রিয়াজ আর কোনটা জাহেদুর, কিছুই ঠাহর করতে পারছিলাম না। এরপরই জ্ঞান হারাই।

জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমি হাসপাতালে। শুরুতে শরীরে একদমই বল ছিল না। হাত নাড়ানোর শক্তিটাও পাচ্ছিলাম না। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই জেনেছি, আমার থেকে মাত্র তিন-চার হাত দূরে থাকা রিয়াজ উদ্দিন ঘটনাস্থলেই মারা গেছে। আর এক হাত সামনে থাকা জাহেদুর আলী গুরুতর আহত হয়েছেন। জাহেদুর ভাইয়ের অবস্থা খারাপ হলে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় সিলেট ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালে। আর আমাদের উদ্ধার করে টমটমে করে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল আশপাশে যারা কাজ করছিল। প্রথমে শ্রীমঙ্গল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সেখানে ডাক্তার না থাকায় মৌলভীবাজার সদর হাসপাতাল।

সেদিনই একটু একটু করে শক্তি ফিরে পেতে শুরু করি। বিকেলেই হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাই। এখন বাড়িতে হাঁটাচলা করার চেষ্টা করি। তবে মাথার ভেতর সব সময় ব্যথা করে। হাত নাড়াতে পারি না। পায়েও যন্ত্রণা করে। আর সেই মুহূর্তটার কথা মনে হলেই শরীরটা কেঁপে কেঁপে ওঠে। মনে হয়, মাত্র তো দুই-তিন হাতের দূরত্ব, রিয়াজের জায়গায় তো আমিও থাকতে পারতাম। আমারও তো রিয়াজের মতো পরিণতি হতে পারত।

আমি গরিব মানুষ। কাজ না করলে ঘরে চুলা জ্বলে না। মরণের ভয় নিয়ে আবার হয়তো মাঠে ফিরতে হবে। তবে জানি না কবে কাজে ফিরতে পারব। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে বড় কষ্টে আছি।