এই দুই প্রশ্নের উত্তরই বলে দেবে, তুমি জয় পেয়েছ কি পাওনি
জন ম্যাকেনরো কিংবদন্তি মার্কিন টেনিস খেলোয়াড়। টেনিসের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র পুরুষ খেলোয়াড়, যিনি একক এবং দ্বৈত—দুই ধরনের খেলাতেই একই সময়ে র্যাঙ্কিংয়ে ১ নম্বরে ছিলেন। ১৮ জুন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সমাবর্তনে বক্তা ছিলেন তিনি।
সমাবর্তনের গাউন, টুপি আমার কখনোই পরা হয়নি। সে হিসেবে বলা যায়, আজকের এই সমাবর্তন আমারও। আজ যদি বাবা থাকতেন, এই স্টেডিয়ামের সবচেয়ে গর্বিত মানুষটি হতেন তিনি। যে মা-বাবার ত্যাগের বিনিময়ে আজ তোমরা স্ট্যানফোর্ড থেকে সমাবর্তন নিচ্ছ, সবাইকে অভিনন্দন। একটামাত্র সন্তানের যাঁরা মা-বাবা, নিজেদের তাঁরা সৌভাগ্যবান ভাবতেই পারেন। আমার অবস্থাটা ভাবুন, একে একে ছয় সন্তানকে কলেজ পাস করিয়েছি!
তবে স্ট্যানফোর্ডের সঙ্গে আমার একটা হিসাব চুকানোর আছে। মার্চ মাসে এখানে সমাবর্তন বক্তা হওয়ার আমন্ত্রণ পাই। আমি যখন এখানে আসব বলে বিমানের সময় মেলানোর চেষ্টা করছি, তখন আমার ছোট মেয়ে এসে জানাল, স্ট্যানফোর্ড ল স্কুল তাকে ভর্তি নেবে না বলে জানিয়েছে। সে বলছিল, ‘বাবা, তুমি নিশ্চয়ই বক্তৃতা দিতে যাবে না? ওরা তোমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিয়েছে, তোমার ভাগনিকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এমনকি তুমি যাদের রিকমেন্ডেশন লেটার (সুপারিশপত্র) দিয়েছ, তাদের সবাইকে ফিরিয়ে দিয়েছে!’ বুঝতেই পারছ, গাছ যেমন, ফল তো তেমনই হবে।
যখন স্ট্যানফোর্ডকে বয়কট করব বলে ভাবছি, তখনই জানলাম, স্ট্যানফোর্ডের ইতিহাস আমিই প্রথম পেশাদার ক্রীড়াবিদ, যে সমাবর্তন বক্তা হওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছি। এটা কিন্তু যেনতেন কথা নয়। শুধু আমার জন্য নয়, এটা তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য, ক্রীড়াজগতের জন্যই একটা বড় ব্যাপার।
সবাই একটা দুর্দান্ত ক্যারিয়ার চায়। কিন্তু স্রেফ কাজ-কাজ করে জীবনের আনন্দ হারিয়ে ফেলো না। কাজ আর জীবনের ভারসাম্য রাখা অসম্ভব মনে হতে পারে, কিন্তু এটাই সবচেয়ে দরকার। এ কথা বুঝতে আমার অনেক দিন লেগেছে।
তোমাদের অনেকের মতো আমিও সব সময় ‘নিখুঁত’ হতে চেয়েছি। এটা আমাদের দোষ নয়। যখন বড় হয়েছি, যা-ই করি না কেন, মনে হয়েছে ঠিক যথেষ্ট হচ্ছে না। টেনিস নিয়ে আমার বাবার কাছ থেকে প্রথম একধরনের চাপ আসে ১২ বছর বয়সে। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, ‘কী করলে তোমরা খুশি হবে?’ বাবা বলেছিল, ‘কলেজের বৃত্তি আর দেশের জন্য খেলা, ব্যস আর কিছু চাই না।’ আমি বলেছিলাম, ‘বাবা, আমার বয়স মাত্র ১২। তুমি কি আর কয়েকটা বছরের জন্য আমাকে নিস্তার দিতে পারো?’ সেই মুহূর্তে বুঝেছিলাম, নিজের জন্য সব সময় নিজেকেই দাঁড়াতে হয়। উল্টো দিকের মানুষটা তোমার বাবা হোক, কিংবা বস, তোমার সবচেয়ে বড় সমর্থক তুমিই।
(আকাশের দিকে তাকিয়ে) বাবা, এখন তুমি খুশি তো?…কী বললে? (কান পেতে শোনার ভান করে) বাবা বলছেন, তাঁর কাছে স্টিভ জবসের বক্তৃতাটাই বেশি ভালো লেগেছিল।
খেলাধুলার ক্ষেত্রে প্রায়ই একটা কথা শোনা যায়—জয়ই শেষ কথা। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। আসল প্রশ্ন হলো—আমি কি আগের চেয়েও ভালো মানুষ হয়ে উঠেছি? আমি যা করছি, তা কি আমার এবং আশপাশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাচ্ছে? এই দুই প্রশ্নের উত্তরই বলে দেবে, আদতেই তুমি জয় পেয়েছ কি পাওনি।
কোনো কিছুতে সাফল্য পাওয়ার পর আমরা আশা করি, আকাশ থেকে আনন্দের ঝরনাধারা নেমে আসবে। কিন্তু এমনটা খুব কমই হয়। সত্যি হলো, জয় কখনো কখনো তোমাকে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। অধিকাংশ সময় জয়ের সঙ্গে সঙ্গে হাজির হয় অমানুষিক চাপ।
অর্জন যত বড় হবে, মনের চাপ বাড়বে তত। অনেক প্রশ্ন তোমাকে রাতে ঘুমাতে দেবে না। আমি কি যথেষ্ট ভালো? যেখানে থাকার কথা, আমি কি সেখানেই আছি? স্ট্যানফোর্ডে পড়েছি, তবু কেন এখনো জীবনসঙ্গী পেলাম না? নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে পড়লে হয়তো পেতাম!
আমার বন্ধু বিলি জিন কিং বলে, ‘চাপ একটি আশীর্বাদ।’ প্রথমবার শুনে ভেবেছিলাম, বোকার মতো ও কী বলছে! চাপ আশীর্বাদ হয় কী করে, চাপ তো ভয়ানক! কিন্তু গভীরভাবে ভেবে আমি পেয়েছি, ওর কথায় যুক্তি আছে। আমরা সৌভাগ্যবান, অনেক ওপরে ওঠার পরও আমাদের চাপে থাকতে হয়। ভুলে যেয়ো না, তুমি এখন যেখানে আছ, সেখানে পৌঁছাতে অনেকে মরতেও রাজি।
অথচ এখানে আসতে তোমাকে অনেক চাপের মোকাবিলা করতে হয়েছে। কোভিডের বাধানিষেধেও তোমরা পড়ালেখা চালিয়ে গেছ। হতাশা, একাকিত্ব, মানসিক চাপ—কত কিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। অনলাইনের পড়ালেখার সঙ্গে খাপ খাইয়েছ, হয়তো এক বছর বিরতি নিয়েছ। বন্ধু, শিক্ষকদের সঙ্গে যুক্ত থাকার ভিন্ন ভিন্ন উপায় খুঁজেছ। কিন্তু এগিয়ে গেছ। বাধা পেরিয়েই তুমি আরও শক্তিশালী হয়েছ। (সংক্ষেপিত)