আমার পরনে তখন বোনের রক্তমাখা ওড়না
১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল নারকীয় হত্যাকাণ্ডে দুই মেয়ে, বাড়িতে আশ্রয় নিতে আসা এক কিশোরসহ শহীদ হন চাঁপাইনবাবগঞ্জের চিকিৎসক মমতাজ হোসেন। সেদিন প্রাণে বেঁচেছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মমতাজ হোসেনের বড় ছেলে জাফর আহমেদ ওসমানী। বিভীষিকাময় দিনটির স্মৃতিচারণা করলেন তিনি।
দুপুর ১২টা কি সাড়ে ১২টা। গোসল করছিলাম। বাথরুম থেকেই শুনতে পাচ্ছিলাম, সদর দরজায় জোরে ঠকঠক আওয়াজ হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারি, দরজা ভেঙে বাড়িতে একদল মানুষ ঢুকে পড়েছে। আতঙ্কিত হয়ে যেভাবে ছিলাম, সেভাবেই বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসি। দেখি ১১ কি ১২ জন পাকিস্তানি সেনা দাঁড়িয়ে। তাদের দেখে তারে মেলা বড় বোনের ওড়নাটা লুঙ্গির মতো করে পরি।
সেনারা বাড়িতে ঢুকেই আব্বাকে নির্দেশ দিল পরিবারের সবাইকে তাদের সামনে হাজির করতে। আম্মাসহ আমরা ছয় ভাইবোন সঙ্গে সঙ্গেই জড়ো হলাম। কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে এলেন আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া হায়দার চাচা, চাচি আর তাঁদের এক ভাগনে। তাঁরা ভয় পেয়ে বাইরে আসতে বিলম্ব করেছিলেন বলে সেনারা খেপে গেল।
আব্বা হায়দার চাচার পরিচয় দিতে গিয়ে বললেন, ‘আমি একজন ডাক্তার। উনি আমার সহকর্মী।’
গ্লাক্সোস্মিথক্লাইনের রিপ্রেজেন্টেটিভ হায়দার চাচা। আব্বার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব। খুলনা থেকে এসে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। ওদিকে আব্বার ডাক্তার পরিচয় পেয়ে মাথাব্যথায় আক্রান্ত এক সেনাসদস্য ওষুধ চাইল। আব্বা বাড়ির একটি ঘরের ডিসপেনসারি থেকে ওষুধ দিলেন। ওষুধ দিতে দিতে সেনাদের উদ্দেশে আব্বা বললেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ইপিআর ক্যাম্পের অধিনায়ক তাঁর পেশেন্ট।
ওই সময় খেয়াল করলাম, সেনারা নিজেদের মধ্যে কানে কানে কথা বলছে। এরপরই বাড়িতে লুটপাট শুরু করল। সিন্দুক ভেঙে সোনার গয়না আর দামি জিনিসপত্র নিল। এরপর দোতলার ঘরগুলোতে গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল। একইভাবে এরপর নিচতলার ঘরগুলোতে আগুন দিল। আমরা নির্বাক।
আমি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। আকস্মিক ঘটনায় ভয়ে কুঁকড়ে যাই। আতঙ্কে কেউ কোনো কথাই বলতে পারছিলাম না। এরপর একটি ঘরে আমাদের ঢুকতে বলা হলো। আব্বা, মা, মায়ের কোলে ছোট্ট জামিল আর তাঁর আঁচল ধরে আমার দুই বছরের ছোট জাকি, হায়দার চাচা, চাচি, তাঁদের ভাগনে, আমার দুই বোনের সঙ্গে আমি তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢুকে পড়লাম। যে যার মতো আশ্রয় নিলাম সোফার পাশে, খাটের নিচে। অন্ধকার ঘরটা বাইরে থেকে বন্ধ করার ব্যবস্থা নেই। ওদিকে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আছি।
এর মধ্যেই গুলির শব্দ। সেই শব্দে কানে তালা লেগে গেল।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সেনারা বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর সোফার পাশে আর খাটের নিচে থেকে বের হই। বের হতেই মেঝেতে দেখি, আমার বড় বোন (মাহবুবা খাতুন) আর হায়দার চাচার ভাগনে (নামটা এখন মনে পড়ছে না) গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। হতবিহ্বল হয়ে আমরা তাঁদের ধরতে ধরতেই শুনি, আব্বার ঊরুতে আর ছোট বোন মাসকুরা খাতুনের পেটেও গুলি লেগেছে।
আহত আব্বা আর ছোট বোনকে নিয়ে আমরা দ্রুত আশ্রয় নিই পাশের এক পরিত্যক্ত বাড়িতে। মা আমাকে পাঠায় আব্বার বন্ধু ফজলুর রহমান চাচার বাসায়। আমি রুদ্ধশ্বাসে দৌড় দিয়ে পৌর এলাকার টিকটিকিপাড়ায় তাঁর বাসায় যাই। আমার পরনে তখন বড় বোনের ওড়না। ঘরে তাঁকে ধরতে গিয়ে ওড়ানাটায় রক্তে লেগেছে। ফজলুর রহমান চাচার ছেলে ওহাব আমাকে একটি হাফপ্যান্ট ও শার্ট এনে দিলেন পরতে। সব শুনে ফজলু চাচা গরুর গাড়ি ঠিক করলেন আমাদের পরিবারকে নিয়ে আসার জন্য। এই এলাকার রোগীদের চিকিৎসা করতেন আব্বা। সবাই তাঁকে চিনতেন। গরুর গাড়ি নিয়ে গিয়ে হতাহতদের নিয়ে আসা খুব ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তবু গাড়োয়ানেরা বললেন, তাঁরা যাবেন।
সেই গরুর গাড়িতে করে পরিত্যক্ত বাড়িটি থেকে আমাদের সবাইকে টিকটিকিপাড়ায় নিয়ে আসা হলো। সেখানে আব্বার কম্পাউন্ডার সাদিকুলের বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। আব্বার তখন রক্তক্ষরণ চলছিল। শরীর নিস্তেজ হচ্ছিল ক্রমশ। তিনি কম্পাউন্ডারকে নির্দেশ দিলেন স্যালাইন দেওয়ার জন্য। কিন্তু তখন আর ভেইন (শিরা) খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। আব্বা তখন কম্পাউন্ডারকে বললেন, ‘ব্লেড দিয়ে কেটে বের করার চেষ্টা করো।’
কিন্তু তারপরও পাওয়া গেল না। শরীর ধীরে ধীরে আরও নিস্তেজ হয়ে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। রাতে নামোশংকরবাটীতে জানাজা শেষে আব্বা, বড় বোন আর হায়দার চাচার ভাগনেকে দাফন করা হলো।
২২ এপ্রিল ভোরে গরুর গাড়িতে করে আমরা চলে যাই দাদার বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ডোমকুলি গ্রামে। ছোট বোনটা তখনো কাতরাচ্ছিল। সেদিনই তার মৃত্যু হয়।
আব্বা আর দুই বোনকে হারিয়ে আম্মা শোকে পাথর হয়ে যান। আমরা ভাইবোনেরা ট্রমার শিকার হই। এভাবেই কাটে দীর্ঘদিন। তারপর ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম। শোক বুকে চেপে আম্মা আমাদের লালন–পালন করতে থাকেন, লেখাপড়ায় এগিয়ে যাওয়ার সাহস দিতে থাকেন। আব্বা আমাকে ডাক্তার বানাবেন বলতেন। কিন্তু হতে পারিনি বলে দুঃখ হয়। তবে আমরা ভাইবোনেরা সবাই প্রতিষ্ঠিত হই।
আব্বা আর বোনদের হারানোর দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গায়ে কাঁটা দেয়। মনে হয় এই তো সেদিনের ঘটনা। তখন মনে মনে সান্ত্বনা খুঁজি— দেশের স্বাধীনতায় আমাদের পরিবারের মতো কত-না লাখো প্রাণ ঝরেছে। স্বজন হারানোর বেদনা তারাও ভোগ করছেন। কিন্তু দুঃখও হয় এই ভেবে, এত সংগ্রাম, এত প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতার সুফল পায়নি সবাই। আজও সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
অনুলিখন: আনোয়ার হোসেন