সিজিপিএ ৪–এ ৩.২৫, কাঙ্ক্ষিত ফল কি পেয়েছেন
খুমিদের হয়ে যখন প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাই, সেটাই আসলে আমার জন্য বড় ভালো লাগার বিষয় ছিল। ফলাফল নিয়ে আমি কখনোই অতটা সিরিয়াস ছিলাম না। গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগে ব্যবহারিক দক্ষতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নিজেকে সেভাবেই গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। তা ছাড়া পড়াশোনার পাশাপাশি একটা খণ্ডকালীন চাকরি করেছি—বিকেল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সেখানেই থাকতে হতো। ক্লাস শেষে ছয় ঘণ্টা অফিস, খুবই ক্লান্ত হয়ে যেতাম। বলতে গেলে একাডেমি পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াই আমার জন্য কষ্টসাধ্য ছিল। সে বিবেচনায় সিজিপিএ ৩.২৫ পেয়ে আমি সন্তুষ্ট।
খুমি জনগোষ্ঠীর অনেকেই লেখাপড়ার সুযোগ পায় না। আপনার আগ্রহ হলো কীভাবে?
খুমিদের সবদিক থেকে পিছিয়ে পড়ার মূল কারণই শিক্ষা। আমাদের জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাক্ষরতার হার মাত্র ২৮। বাবা ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনিই আমার অনুপ্রেরণা। অর্থাভাবে নিজে স্নাতকে ভর্তি হতে পারেননি। চাইতেন, আমাকে দিয়ে তাঁর স্বপ্ন পূরণ করবেন। আমি তাঁকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি মাত্র।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন, এটা কখন ঠিক হলো?
আমার স্কুল ও কলেজ ছিল কোয়ান্টাম কসমো স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এটি বান্দরবানের লামার সরই ইউনিয়নের এক প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত। প্রতিবছর বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র ভাইদের পড়তে দেখেছি। তাঁদের দেখে আমারও ইচ্ছা হতো। যখন জানলাম, খুমি জনগোষ্ঠীর আর কেউ এর আগে দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েনি, তখনই মনে মনে একটা চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম—এই বৃত্ত ভাঙতে হবে, নতুন ইতিহাস লিখতে হবে।
দুর্গম পাহাড় থেকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে, যাত্রাটা নিশ্চয়ই সহজ ছিল না?
খুমিরা সাধারণত দরিদ্র। জুমচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। বাবার সামান্য বেতনে সংসার চলত না। জুমচাষ করে, ফলমূল চাষবাস করে আমাদের পড়াশোনার খরচ চালাতেন তিনি। বাসায় ছুটিতে গেলে নিজেও কাজে লেগে যেতাম। এরপর জেএসসি পরীক্ষা যখন দিচ্ছি, বাবাও আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। পরিবারের অবস্থা এত খারাপ ছিল যে অনেকে মাকে পরামর্শ দিয়েছিল, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে জুমচাষ শেখাতে। মা কারও কথা শুনলেন না। নিজের জমানো সব টাকা খরচ করে স্থানীয় সরকারি স্কুলে ভাইবোনদের ভর্তি করালেন। তত দিনে আমিও এইচএসসি পাস করে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং শুরু করেছি। সে সময় কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে আশ্বাস পেলাম, যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাই, তারা ভর্তির খরচ বহন করবে। পাশাপাশি খণ্ডকালীন একটা চাকরির ব্যবস্থাও নাকি করে দেবে। এই সুযোগের জন্য হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আমার সামনে কোনো বিকল্প ছিল না।
বাবার ইচ্ছা তো পূরণ হলো। এরপর?
পড়াশোনার পাশাপাশি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে ডিজাইন অ্যান্ড অ্যানিমেশন টিমের সঙ্গে কাজ করছি। আমরা সামাজিক সমস্যার ওপর সচেতনতামূলক অ্যানিমেশন ভিডিও বানাই। ভবিষ্যতে ইচ্ছা আছে অ্যানিমেশন সেক্টর নিয়ে বড় পরিসরে কাজ করার। পার্বত্য বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর লোকগল্প, রূপকথা, মিথগুলোকে অ্যানিমেশনের মাধ্যমে সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। এ ছাড়া আমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের মোটিফ ডিজাইন নিয়ে কাজ করারও ইচ্ছা আছে।