অল্প অল্প টাকা জমিয়ে মায়ের জন্য কিনে ফেললাম সোনার বালা

প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বিশ্বজুড়ে পালিত হয় মা দিবস। সেই হিসাবে আগামীকাল মা দিবস। দিনটি উপলক্ষে মাকে নিয়ে পাঠকের কাছে লেখা আহ্বান করেছিল ‘ছুটির দিনে’। সেই আহ্বানে বিপুল পাঠক সাড়া দিয়েছেন। নির্বাচিত লেখাগুলোর একটি পড়ুন এখানে।

মায়ের সঙ্গে লেখক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

বাবা মারা গেলে আমাদের বিশাল পরিবারটা অথই সমুদ্রে পড়ে গেল। ভুনা রুই মাছের বড় মাথাটা মা যাঁদের পাতে তুলে দিতেন, সেই সব আত্মীয়ের পদধূলি থেকে বঞ্চিত হলো আমাদের আঙিনা। ভাসমান শেওলা যেমন জানে না তার গন্তব্য কোথায়, তেমনই মা–ও হয়ে পড়লেন দিশাহারা। ১২ সদস্যকে নিয়ে শুরু হলো তাঁর অনিশ্চিত যাত্রা।

আমার বয়স তখন চার বছর। মায়ের কোলে আমার ছোট দুই ভাই-বোন। তবু মা ভেঙে পড়লেন না। মায়ের সঙ্গে যুক্ত হলেন বড় ভাই আর ন’বুবু, আমার চতুর্থ বোন। বড় ভাইয়ের অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়া হলো না। তার ছোট কাঁধে চাপল বিশাল দায়িত্বের বোঝা। মায়ের পাশে দাঁড়াবে বলে ন’বুবুও অনার্স তৃতীয় বর্ষেই পড়াশোনা ছেড়ে দিল। স্বাস্থ্য সহকারী পদে একটি সরকারি চাকরির ব্যবস্থাও করে ফেলল। ভালোবাসা ও শাসনের চাদরে আমাদের আগলে রাখলেন মা।

আমি খুব তোতলা ছিলাম। কথা ভীষণ বেধে যেত। মাঝেমধ্যে কথা বলতে বলতে চোখ দিয়ে পানি চলে আসত। কাউকে ঠিকমতো বোঝাতে পারতাম না, আমার কী দরকার। কিন্তু মা ঠিকই সব বুঝে নিতেন। আমাকে সান্ত্বনা দিতেন। সব সময় নিজের কাছে রাখতেন। আমার কোনো বন্ধু ছিল না। তোতলাদের বন্ধু হয় না। তাদের সঙ্গে মজা নেওয়ার জন্য কিছু লোক সদাপ্রস্তুত থাকেন। আত্মীয়স্বজন আর প্রতিবেশীদের লাঞ্ছনা সইতে সইতে শৈশব কাটল।

আমি তখন প্রাথমিকে পড়ি। প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্ট হলো। শত শত শিক্ষার্থীর ভেতর আমি বৃত্তি পেলাম। মায়ের তোতলা ছেলেটা বৃত্তি পেয়েছে। মা আর ভাইবোনেরা কী খুশি!

পড়াশোনায় ভালো হওয়ার কারণে মা আমাকে খুব আগলে রাখতেন। বাড়ির বাইরে ক্রিকেট খেলতে যাওয়া একদম বারণ। তারপরও চুরি করে খেলতে যাওয়া একটা নেশায় পরিণত হলো। এসএসসির টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট হলো। আমার অবস্থান চতুর্থ। মা খুব রাগ করলেন। আমার খেলা বন্ধ। পড়ার টেবিলে বসে আছি। খুব মেজাজ নিয়ে আমার পাশে এসে বসলেন তিনি। তারপর তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, ‘তোমার সঙ্গে কথা আছে। আজ তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ হাতের দুটি আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘এখান থেকে একটি বেছে নাও। ’ প্রথম আঙুলে ক্রিকেট, দ্বিতীয় আঙুলে পড়াশোনা। ভেউ ভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে আমি পড়াশোনাকেই বেছে নিলাম।

উচ্চমাধ্যমিক শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলাম। আমার সদা সংগ্রামী মা আনন্দে কেঁদে ফেললেন। বললেন, ‘আজ যদি তোর আব্বা বেঁচে থাকত! ’ তোতলা ছেলেটার একটা গতি হলো দেখে মা খুব খুশি হয়েছিলেন।

সদ্য মাস্টার্স শেষ করেছি। মা দুষ্টুমির ছলে বলেন, ‘আমার হাতে যদি দুটি সোনার বালা থাকত!’ এটা আমাকে খুব ভাবিয়ে তুলল। অল্প অল্প করে টাকা জমালাম। কিনে ফেললাম মায়ের জন্য সোনার বালা। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে গিয়েছি। মাকে সারপ্রাইজ দেব। সবকিছু প্রস্তুত। ভাইবোনদের একত্র করেছি। তারা অবশ্য বুঝতে পারছে না ব্যাপরটা কী। বড় ভাবির হাতে তুলে দিলাম বালা দুটো। তিনি মায়ের হাতে পরিয়ে দিলেন। আমাদের আকস্মিক কর্মকাণ্ডে মা হতবাক। তাঁর মুখ দিয়ে কোনো কথা সরছে না। আমি বলতে পারব না, মা কতটুকু খুশি হয়েছিলেন। মায়ের জন্য কিছু করতে পেরেছি অনুভব করে কেঁদেছিলাম সেদিন। দিনটি আমার জীবনে সবচেয়ে আনন্দের।

লেখক: শিক্ষক, আহসানউল্লাহ ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি