আইনের বইয়ে ছবি থাকে না

আঁকা: আরাফাত করিম

জিগাতলা পোস্ট অফিসের কাছে মনেশ্বর রোড। সেখানকার একটা বাসার তিনতলায় রুম ভাড়া নিয়ে থাকি আমরা দুই বন্ধু। মামুন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করে। আর আমি বিচারক হওয়ার জন্য দিনরাত পড়ি। দিনরাত বলছি এ কারণে যে তখন শয়নে-স্বপনে-নিশি-জাগরণে একটাই চিন্তা, যেভাবে হোক জজ হতে হবে।

প্রিলিমিনারি পরীক্ষা শেষে লিখিত পরীক্ষা চলছে। এর কিছুদিন আগে আমগাছ থেকে পড়ে মেরুদণ্ডের একটি কশেরুকা ভেঙে যায়। ঢাকায় ভাঙা মেরুদণ্ডের চিকিৎসা আর পড়ালেখা—দুটোই একসঙ্গে চলতে থাকে। মেরুদণ্ডের তীব্র ব্যথার চোটে একনাগাড়ে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারি না। কখনো দাঁড়িয়ে, কখনো বসে, কখনো হেঁটে হেঁটে পড়তে হয়। ১০টি বিষয়ে ১ হাজার নম্বরের লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি এভাবেই নিয়েছি।

আড়ষ্টতা কাটাতে মাঝেমধ্যে শিশুদের মতো চিৎকার করে পড়ি। পড়ার রুমের পূর্ব দিকে এক গলি পরে আরেকটি বহুতল ভবন। হঠাৎ একদিন বিকেলে সেই ভবনের তিনতলা থেকে ভেসে আসে একটা ছোট্ট শিশুর আওয়াজ। দেখি প্রায় পাঁচ, সাড়ে পাঁচ বছরের একটি মেয়ে আমাকে ডাকছে।

‘এই তুমি কী পড়ো?’

‘বই পড়ি, বই,’ জোরে উত্তর দিই।

‘কী বই পড়ো?’

‘আইনের বই।’

সে আইনের বই বোঝে না। বলে, ‘তোমার বইগুলো আমাকে দেখাও তো দেখি।’

আমি জানালার ফাঁক দিয়ে আমার মোটা মোটা বই দেখাই‌।

‘তোমার বইয়ে কি ছবি আছে?’

‘না ছবি নাই, গল্প আছে।’

‘আমার কাছে অনেক ছবির বই আছে,’ বলে সে দৌড়ে গিয়ে একটা ছবির বই নিয়ে আসে। গলির ওপার থেকে পাতা উল্টে আমাকে দেখানোর চেষ্টা করে। ইতিমধ্যে ভেতর থেকে তার ডাক পড়ে। বই নিয়ে দেয় ভোঁ–দৌড়।

খাওয়া আর গোসল বাদে বাকি সবটুকু সময় পড়েও আমার পড়া শেষ হয় না।

পরদিন সকালে পাশের বাসার বেলকনি থেকে আবার ডাক, ‘তোমার নাম কী?’

‘আমার নাম মতিউর। তোমার নাম কী?’

সে আমাকে তার নাম বলে।

এরপর তাকে বললাম, ‘আমার পরীক্ষা চলছে। এখন পড়ি, তুমি যাও।’

‘কী পরীক্ষা?’

‘জজের পরীক্ষা,’ বলেই আবার পড়ায় মন দিই।

কিন্তু তার কথা ফুরায় না। সে কথা বলতেই থাকে, ‘জজ মানে কি টিভিতে যারা বিচার করে, তুমি সেই জজ হবে?’

‘হ্যাঁ।’

‘তাহলে কি তোমাকে টিভিতে দেখতে পাব?’

এসব কথোপকথনের মধ্যেই আমার কয়েকটি পরীক্ষা হয়ে গেছে। মেয়েটি প্রতিদিন বেলকনিতে এসে আমার সঙ্গে কথা বলে।

‘তুমি কি আমার বন্ধু হবে?’

ছোট্ট মেয়েটির এই প্রশ্নে অবাক হই। অনিন্দ্যসুন্দর ছোট্ট শিশুটি আমার নিঃসঙ্গতার বন্ধু হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু এই ছোট শিশুর এমন অসম বন্ধুত্বের প্রশ্ন আমাকে ভাবায়।

জিজ্ঞেস করি, ‘তোমাদের বাসায় কে কে থাকে?’

‘আমার দাদি থাকে।’

‘আর কেউ থাকে না?’

‘না। আব্বু-আম্মু ডিউটিতে যায়।’

ঢাকা শহরের এই বন্ধ বাসায় একাকী এই শিশুর যে একদম ভালো লাগে না, বুঝতে কষ্ট হয় না। ওর জন্য প্রতিদিন চকলেট নিয়ে আসি। ১৫-২০ ফুট দূরের বেলকুনিতে ছুড়ে দিই একটার পর একটা। সে আমার সঙ্গে গল্প করতে থাকে। অনেক গল্প। অবলীলায় নাম ধরে ডাকে। জানালা বন্ধ থাকলে জোরে চিৎকার করে। সাড়া না দিলে ভীষণ মন খারাপ করে।

মাঝেমধ্যে বিকেলে এসে জিজ্ঞেস করে, ‘আমার জন্য চকলেট এনেছ মতিউর?’

আনিনি বললে তার আদেশ, ‘যাও এক্ষুনি আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসো।’

বাধ্য ছেলের মতো পড়া বন্ধ করে নিচ থেকে চকলেট নিয়ে আসি।

একদিন দুপুরে পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। হঠাৎ শুনি চিৎকার করে সে আমাকে ডাকছে, ‘মতিউর ওঠো, সর্বনাশ হয়ে গেছে!’

হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কী হয়েছে?’

‘বসুন্ধরা সিটিতে আগুন লেগে সব পুড়ে গেছে। তোমাদের বাসায় টিভি নাই? টিভিতে দেখো এখনো আগুন জ্বলছে।’

‘আমাদের তো টিভি নাই।’

‘তুমি না হয় আমাদের বাসায় দৌড়ে আসো, দেখতে পাবে,’ বলেই আবার চুপ হয়ে যায়। একটু পরে বলে, ‘থাক এসো না।’

‘কেন? তোমাদের বাসায় যেতে নিষেধ করলে কেন?’

‘আব্বু-আম্মু তোমার সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করেছে। আচ্ছা তুমি কি ছেলেধরা?’

‘কেন? কী হয়েছে বলো তো?’

‘আব্বু বলেছে, অপরিচিত লোকের সঙ্গে কথা না বলতে। ঢাকায় নাকি অনেক ছেলেধরা থাকে। তুমি তো ছেলেধরা নও তাই না?’

ওর প্রশ্নের কোনো উত্তর দিই না। আমার সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করি। লাখ লাখ মানুষের ভিড়ে ভরা এই শহরে দু-একজন ছেলেধরা থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অনেক শিশু পাচারকারীও আছে। অবুঝ শিশুকে বাসায় রেখে কর্মজীবী বাবা-মায়ের এমন উদ্বেগ হওয়া তাই স্বাভাবিক। মনে মনে ভাবি, শিশুটির সঙ্গে কথা বলা একদম বন্ধ করে দেব। প্রয়োজনে জানালা খুলব না আর কোনো দিন। চকলেট চাইলেও না।

পরীক্ষা প্রায় শেষ হয়ে আসছে। হঠাৎ একদিন দেখি ওদের বাসার বেলকনি মোটা কাপড় দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সারা দিন শিশুটির কোনো দেখা নেই। আমিও এখন আর জোরে জোরে বই পড়ি না। এর মধ্যে মানসিক চাপে একটা পরীক্ষা খারাপ হয়েছে। বেলকনি বন্ধ করে দেওয়াতে ভালোই হয়েছে।

শেষ বিকেলে পর্দা সরিয়ে সে আস্তে করে আমাকে ডাকে, ‘মতিউর…’

প্রতিজ্ঞা ভেঙে দ্রুত উঠে তাকিয়ে দেখি মলিনমুখে চুপচাপ সে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলে না।

বলি, ‘চকলেট নেবে?’

‘না।’

অনেকক্ষণ সে কিছু বলে না। চোখ–মুখ লাল হয়ে আছে। বলে, ‘তোমার সঙ্গে কথা বলতে মানা। আর কোনো দিন দেখা হবে না।’

ওর দিকে আর তাকাতে পারি না। পড়ার বইয়েও মন বসে না। কখনো শিশুটির জায়গা থেকে আবার কখনো শিশুটির বাবার আসনে নিজেকে বসিয়ে ভাবি, এখন কী করা উচিত! একটা ছোট শিশু কষ্ট পাচ্ছে ভেবে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। শেষে বাসা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। বাসা ছেড়ে আসার সময় ওকে একনজর দেখার জন্য মনটা খুব ব্যাকুল হয়ে ওঠে। জানালা দিয়ে ওদের বেলকনিতে তাকিয়ে থাকি অনেকক্ষণ।

ঘটনাটি সেই কবেকার। ২০০৯ সালের। বিদায় নিয়েছে ২০২২ সালও। আমার বিচারক হওয়ারও এক যুগ পার হয়ে গেছে। সেদিনের শিশুটিও এত দিনে নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়ে গেছে। কিন্তু পাঁচ বছরের সেই ছোট্ট শিশুর ছবিটা মনের ফ্রেমে বাঁধানো আছে ঠিক ওভাবেই।