একটি সূত্রই বদলে দিয়েছিল স্টিভ জবসের পুরো কর্মজীবন, কী সেটা
২৮ বছর আগের কথা। মার্কিন প্রযুক্তিবিদ ও ব্যবসায়ী স্টিভ জবস তখন ডুবন্ত কোম্পানি অ্যাপলকে একদম নতুনভাবে সাজাতে শুরু করলেন। সে সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে একটা অসাধারণ শিক্ষার কথা সম্প্রতি শেয়ার করেছেন কানাডীয় ব্যবসায়ী ও টিভি ব্যক্তিত্ব কেভিন ও’লিয়ারি। তিনি বলেছেন, ‘জবসের কাছ থেকে শেখা সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা সময় ব্যবস্থাপনা বা লক্ষ্য নির্ধারণ নিয়ে নয়। এটা আরও গভীর ব্যাপার। জবস জানতেন, কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ আর অপ্রয়োজনীয় জিনিসের মধ্যে পার্থক্য করতে হয়। কীভাবে অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো সরিয়ে নিজের কাজটা করতে হয়। এই একটি ধারণাই তাঁর পুরো কর্মজীবন বদলে দিয়েছে।’ স্টিভ জবসের সেই সূত্রের নাম ‘সিগন্যাল ও নয়েজ’।
সিগন্যাল ও নয়েজ কী
কেভিন ও’লিয়ারি খুব সহজভাবে বিষয়টা ব্যাখ্যা করেছেন। সিগন্যাল হলো সেই ৩-৫টি কাজ, যেগুলো আগামী ১৮ ঘণ্টার মধ্যে অবশ্যই করতে হবে। এসব এমন কাজ, যা না করলেই নয়। এসবই আপনাকে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নেবে। আর নয়েজ হলো বাকি সবকিছু। যেমন অপ্রয়োজনীয় মিটিং, সময় নষ্ট করে ই–মেইল করা কিংবা নানান ধরনের বিভ্রান্তি।
জবস তাঁর জীবনে এই নিয়ম খুব ভালোভাবে মেনেছেন। তিনি ৮০: ২০ অনুযায়ী কাজ করতেন। জবস চাইতেন, তাঁর সময় আর শক্তির ৮০ শতাংশ যাবে সিগন্যালে। আর নয়েজে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ। কিন্তু সাধারণ মানুষ কী করে? তারা ৫০ শতাংশ সময় সিগন্যালে আর ৫০ শতাংশ নয়েজে দেয়। কেউ কেউ তো আরও খারাপ অবস্থায় থাকে। বেশির ভাগ সময় মিটিং ও মেইল চালাচালি করে ভাবে, গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে না কেন!
ও’লিয়ারির মতে, সফল উদ্যোক্তা এবং অন্যদের মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড় পার্থক্য। বিজয়ীরা হয়তো সব সময় সবচেয়ে বুদ্ধিমান বা ভদ্র মানুষ হন না, কিন্তু তাঁরা সিগন্যাল চিনতে ভুল করেন না।
নির্মমতার শক্তি
জবস কাজের অগ্রাধিকার ঠিক করতেন একদম নির্মমভাবে। তাঁর কাছে যা কিছু লক্ষ্যের জন্য অপ্রয়োজনীয়, তা-ই নয়েজ। এর মধ্যে পড়ে আরাম, সামাজিক ভদ্রতা, প্রশংসা, এমনকি আবেগও।
কেভিন ও’লিয়ারি বলেন, ‘জবস ভদ্রতাকে দুর্বলতা মনে করতেন, যখন সেটা কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াত। কোনো আলাপ যদি প্রোডাক্ট তৈরি নিয়ে না হতো, তাহলে তাঁর কাছে সেই আলাপের কোনো দাম ছিল না। কেউ যদি যথেষ্ট দ্রুত কাজ না করত, তাকে ছাঁটাই করা হতো। জবস এটা কঠোর হওয়ার জন্য করতেন না, লক্ষ্য অর্জনের জন্য করতেন। তিনি মনে করতেন, দ্রুত কাজ না করাটা মাঝারি মানের নয়েজ। এটাও নয়েজকে প্রশ্রয় দেওয়া।’
এই কঠোরতা জবসকে অনেকের কাছে অসহ্য করে তুলেছিল। কিন্তু এটাই তাঁকে সফল করেছে। তাঁর এই অবিচল মনোযোগ চারপাশের মানুষকে বাধ্য করত নিজেদের সেরাটা দিতে, নয়তো সরে যেতে হতো।
আবেগের নিয়ন্ত্রণও কাজের অংশ
বেশির ভাগ মানুষ ভাবে, উৎপাদনশীলতা মানে শুধু কাজ আর সময়ের ব্যাপার। কিন্তু জবস বুঝেছিলেন, আপনার মানসিক অবস্থাও এখানে বড় ভূমিকা পালন করে। ও’লিয়ারি বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বলেছেন। তিনি বলছেন, কোনো খবর চরম বিপর্যয়ের হোক বা চরম আনন্দের—কোনোটিই যেন আপনাকে পথভ্রষ্ট না করে।
কেন? কারণ, আবেগ যখন নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, তখন সেটা নয়েজে পরিণত হয়। খারাপ খবরের আতঙ্ক হোক বা জয়ের উদ্যাপন, আসল বিপদটা একই—আপনি সিগন্যাল থেকে দূরে সরে যাবেন।
জবস নিজেকে এমনভাবে গড়ে তুলেছিলেন, যেন যেকোনো পরিস্থিতিতে তিনি স্থির থাকতে পারেন। তাঁর মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকত দুটি প্রশ্ন—এখনো কী কাজ বাকি এবং সিগন্যাল বা মূল লক্ষ্য কী? পরিস্থিতি যা-ই হোক, কাজ শেষ করাই হলো মূল কথা। ও’লিয়ারির মতে, এই আবেগীয় শৃঙ্খলাই সফল নেতাদের অন্যদের থেকে আলাদা করে।
স্টিভ জবস ও ইলন মাস্ক: আলাদা মানুষ, একই শক্তি
স্টিভ জবস ও ইলন মাস্কের ইনটেন্স বা কাজের প্রতি গভীর মনোযোগের ব্যাপারটা প্রায় একই। তবে শুধু গভীর মনোযোগ তাঁদের সফল করেনি, আসল ব্যাপার হলো, তাঁরা কোন বিষয়ে মনোযোগী।
ও’লিয়ারির মতে, দুজনের মধ্যে একটি জায়গায় মিল আছে। তাঁরা মূল লক্ষ্যের ওপর শতভাগ মনোযোগ দেন। জবস কখনো মানুষের মনোযোগ বা অ্যাটেনশন খোঁজেননি, তিনি খুঁজেছেন ফলাফল। অন্যদিকে মাস্ককে মানুষ পছন্দ করল কি না, তা না ভেবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পেছনে ছুটেছেন।
ও’লিয়ারি উল্লেখ করেছেন, এই তীব্র মনোযোগের কারণে এই নেতাদের সঙ্গে কাজ করা বা তাঁদের আশপাশে থাকাটা কঠিন হতে পারে। কিন্তু এ কারণেই তাঁরা সফল। এই একই কারণে তাঁরা এমন সব জিনিস তৈরি করেন, যা নিয়ে অন্যরা শুধু আলোচনাই করে যায়। তাঁরা কখনো নয়েজ বা অগুরুত্বপূর্ণ কাজে ফোকাস করেননি।
আমাদের কী শিক্ষা নেওয়া উচিত
আপনি যদি না জানেন আপনার সিগন্যাল বা মূল লক্ষ্য কী, তাহলে সারা দিন কেটে যাবে নয়েজের পেছনে ছুটতে ছুটতে। নিজের লক্ষ্য ঠিক করতে না পারলে সারা দিন মিটিং, মেসেজ আর ছোটখাটো সিদ্ধান্তের ভিড়ে আপনি হারিয়ে যাবেন। শুনতে সহজ মনে হলেও কাজটা করা মোটেও সহজ নয়। এ কারণেই বেশির ভাগ মানুষ বিষয়টি এড়িয়ে যায়। আর যারা এড়িয়ে যায় না, তারাই কাজ শেষ করে, এগিয়ে যায় এবং নেতৃত্ব দেয়।
তাই নিজেকে প্রশ্ন করুন, এই মুহূর্তে আপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো কী কী? কোন পাঁচটি কাজ আগামী ১৮ ঘণ্টার মধ্যে অবশ্যই করতে হবে? একই সঙ্গে এটাও ভাবুন, কোন কোন বিষয় আপনাকে এই পাঁচটি কাজ করতে বিভ্রান্ত করছে। সেসব ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিন।
মোদ্দাকথা হলো, আপনাকে গুরুত্বপূর্ণ আর অগুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে। এ কাজটা করতে পারলেই বাকিটা সহজ হয়ে যাবে। গুরুত্বপূর্ণ কাজটা গুরুত্বসহকারে করুন, তবে অন্যটা কাছে ঘেঁষতে দেবেন না। তাহলে আপনিও হবেন সফল।
সূত্র: মিডিয়াম