আমি আর মা খুব আলাদা দুজন মানুষ। খাবার, পোশাক এমন ছোটখাটো বিষয় থেকে জীবনবোধ—অনেক ক্ষেত্রেই মিল খুব কম।
মা রক্ষণশীল পরিবারে বড় হয়েছেন। এমন পরিবারের মেয়ে হিসেবে তিনিই প্রথম স্নাতক। সেটাও একদম নিজের গরজে। মায়ের ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন পড়ার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তা পড়তে যেতে হতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, থাকতে হতো হলে। তাই পরিবার থেকে অনুমতি মেলেনি। রংপুরের বাসায় থেকেই কারমাইকেল কলেজে যে বিষয়ে স্নাতকোত্তর করা সম্ভব, সেই বিষয়েই স্নাতক পড়লেন।
স্নাতকোত্তর করার পর বিএডে ভর্তি হলেন। এরপরই বিয়ে হয়ে গেল। দেড় বছরের মাথায় আমি জানান দিই যে আসছি। প্রথম ট্রাইমেস্টারে (সন্তানধারণের পর ০ থেকে ১৩ সপ্তাহ) রিকশায় যাওয়া–আসার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। বিএড শেষ করতে পারলেন না। কাজেই মায়ের জীবনে আমার প্রথম ‘অবদান’ তাঁর পড়াশোনার পাট চুকানো। মায়ের পড়াশোনা করার ইচ্ছাটা আজও বোঝা যায়।
সেদিন বিকেলে ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে মাকে নিয়ে হাঁটছিলাম। আশপাশে অনেক আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্রী, কেউ মাঠে বসে পড়ছে, কেউ সাইকেল চালাচ্ছে। মা হঠাৎ বললেন, ‘আমরা এমন জায়গায় পড়ার সুযোগ পেলাম না, জীবনটা বোঝার আগেই চলে গেল।’
মায়ের জীবনে আমার দ্বিতীয় অবদান পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বা পিডিডি (সন্তান জন্মদানের পর মায়ের বিষণ্নতা)। ছোটবেলায় শুনতাম, আমার জন্মের পর মায়ের নাকি আমাকে কোলে নিতে ইচ্ছে করত না। শুনে তখন রাগ হয়েছিল। আজ বুঝি, তখন মায়ের মানসিক অবস্থা বোঝার মতো কেউ ছিল না। আজও আমাদের সমাজ পিপিডিকে গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু মায়ের কারণেই আমি আমার পিপিডি নিয়ে সচেতন হতে পেরেছিলাম।
বলা যায়, মায়ের কাছ থেকে আমি প্রথম যে শিক্ষা নিজেকে দিয়েছি, তা হলো কোনোভাবেই অন্যের জন্য নিজেকে দমিয়ে না রাখা। আমার ছেলে হওয়ার ১৭ দিনের মাথায় আমি কনফারেন্সে পেপার দিয়েছি। নিজে মা হয়ে আমার মাকে প্রতিনিয়ত নতুন করে আবিষ্কার করছি।
আমাদের জন্য নিজের সব ছাড়া এই মানুষ কিন্তু খুব আত্মবিশ্বাসী। ছোটবেলায় একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে পিজি হাসপাতালের সামনে একটা মুড়ির টিন মার্কা বাস আমাদের গাড়িতে লাগিয়ে দিয়ে সামনের লাইট নষ্ট করে দিল। সংসারের একটা বড় ক্ষতি চুপচাপ বসে দেখার পাত্র মা নন। ২০০০ সালে ঢাকার রাস্তায় মধ্যবয়সের একজন নারী সোজা গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাস থামাল এবং বাস ড্রাইভারকে দোষ স্বীকার করালেন। এই আত্মবিশ্বাস মায়ের সবচেয়ে বড় পুঁজি।
মায়ের কাছ থেকে আমি মানুষকে উপহার দেওয়া, ছোট–বড় বিভিন্ন আনন্দ উদ্যাপন করা—এই দুই শিখেছি। কাছের কারও যেকোনো আনন্দের ঘটনা ঘটলেই আমি উপহার দিই, সেটা একটা কার্ড হতে পারে, হতে পারে এক গোছা ফুল বা একখানা শাড়ি। মায়ের কাছে আরও শিখেছি, কারও জন্য কিছু করতে গেলে যেন মান বজায় রেখে করি। নিজের জন্য যেভাবে করব, আরেকজনের জন্যও যেন সেভাবেই করি।
সংসারকে নিরাপদ রাখার জন্য দরকারের চেয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করতেন মা। আজ নিজে সংসার করতে গিয়ে দেখি, আর্থিক এবং পারিবারিক নিরাপত্তার বিভিন্ন বিষয় অজান্তেই মনে উঁকি দেয়।
আমি জানি, আমার পরিচিতদের চোখে মা হচ্ছেন ছেলেমেয়েকে নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করা, সংসারপটু একজন নারী। কিন্তু আমার মা জীবনটা নিজের শর্তে বেঁচেছেন। কিছু কম্প্রোমাইজ আছে তাঁর, কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর তাঁর আত্মবিশ্বাস ছাড়া আর কোনো দিকে মা তাকাননি।
মায়ের আত্মবিশ্বাস অনেক সময় আমার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়েছে। কিন্তু আজ আমার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, কর্মক্ষেত্রে স্বাধীনতা, এমনকি আমি নিজে কোন ধরনের মা হব—এই সবকিছুতেই আমার মায়ের প্রভাব আছে।
মাকে, মা দিবসের শুভেচ্ছা।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টল ল স্কুল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক