বইয়ের ছবি, ছবির বই এবং শিশুদের হাসিমুখ
শিশুটি খুশিতে লাফাচ্ছিল আর বলছিল, ‘মেঘ! মেঘ! মেঘ!’
কী জানি, সত্যি সত্যি মেঘ দেখেও ও বোধ হয় এত লাফায়নি কখনো! রাজধানীর ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে চলছে ছোটদের বইয়ের প্রকাশনী ‘ইকরিমিকরি’ আয়োজিত ‘আ ওয়ার্ল্ড অব পিকচার্স বুক’ প্রদর্শনী। সেখানেই দেখা মিলল মেঘ দেখে খুশিতে আটখানা শিশুটির।
প্রদর্শনী গ্যালারিতে ঢুকলেই দেখা যাবে ইকরিমিকরির বই ‘ফাংসাং’–এর ইয়া বড় পাখিটি মৃদু পাখা নেড়ে নেড়ে যেন বলছে, ‘এসো এসো, স্বাগত!’ বাঁয়ের দেয়ালে সাঁটা ইকরিমিকরির আরেকটি বই ‘মেঘ রাজকন্যা’র মেঘ। ফুফুর হাত ধরে প্রদর্শনী দেখতে আসা শিশুর উচ্ছ্বাসের সেই মেঘ।
দুই কদম এগোলে প্রখ্যাত শিল্পী রফিকুন নবীর হাতে আঁকা অলংকরণ। টোলে রাখা ইকরিমিকরির বই ‘রনবী ও কাঠঠোকরা’র অলংকরণগুলো ছেলে–বুড়ো সবাই দেখছিলেন বড় বড় চোখে। গ্যালারিজুড়ে আরও কত যে ছবি! রঙিন ও প্রাণবন্ত। প্রকৃতির ছবি, পাখির ছবি, ফুলের ছবি, প্রাণীর ছবি, আরও কত কত ছবি! সব মিলিয়ে ইকরিমিকরির ৭০টি বইয়ে ৩২ জন শিল্পীর আঁকা প্রায় ৩০০ ছবি ঠাঁই পেয়েছে প্রদর্শনীতে। শুধু বইয়ের ছবি নয়, আছে ৫০টি বর্ণের ছবিও। এঁকেছেন ৫০ জন শিল্পী। বইয়ের ছবি, বর্ণ ছবি—কোনটা রেখে কোনটার কথা বলি! প্রতিটি ছবির দিকে তাকালে মনে হয়, ছবি কথা বলছে।
‘শিশুতোষ বইয়ের অলংকরণ প্রদর্শনীর এত সুন্দর আয়োজন বাংলাদেশে এই প্রথম।’ এমনটাই বলছিলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আসা এক অভিভাবক। প্রবল উচ্ছ্বাস নিয়ে আরও বলছিলেন, বাড়ি ফিরে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের বলবেন বাড়ির শিশুদের নিয়ে অবশ্যই যেন এই প্রদর্শনী দেখতে আসেন। বলতে বলতে নিজের শিশুটিকে কাঁধ থেকে নামিয়ে কাঠের ঘোড়াটির পাশে দাঁড় করালেন ছবি তুলতে।
প্রদর্শনীতে দুটি কাঠের পঙ্খীরাজ ঘোড়া আছে। এ ছাড়া ইকরিমিকরির বই ‘অনেক অনেক দিন আগে হুক্কা টানতো বাঘে’র বাঘগুলোও আছে। একটা বাঘ দেয়ালে ঘাপটি মেরে বসে আছে, আরেকটা মেঝেতে দাঁড়িয়ে। মেঝেতে বিশাল আকারের একটা বইও আছে।
২ মে প্রদর্শনীর উদ্বোধনী দিনে ছিল জলপুতুলের পাপেট শো। মঞ্চের সামনে শিশুরা একেবারে টইটম্বুর। গ্যালারি কানায় কানায় পূর্ণ অভিভাবক, শিল্পী, লেখক, সাংবাদিক ও শুভাকাঙ্ক্ষীতে। পরের দিন ৩ মে ছিল দুটি পর্ব। প্রথম পর্বে শিশুরা মনের আনন্দে একের পর এক ছবি এঁকে গেছে। দাঁড়িয়ে, শুয়ে, বসে নানান ঢঙে ওরা ছবি আঁকছিল গ্যালারির একটা ফাঁকা দেয়ালে নিজের হাতে ছবিটা সেঁটে দেবে বলে।
পরের দিনগুলোতে শিশুদের আঁকা, রং করা এসব ছবিও প্রদর্শনীতে আলো ছড়াতে শুরু করেছে। সেদিন দ্বিতীয় পর্বে শিশুতোষ বইয়ের লেখক ও শিল্পীদের আলাপ ছিল। এই আলাপে প্রথমবার দেখা হলো এমন অনেক লেখক, শিল্পীর সঙ্গে, যাঁদের একজন বইটি লিখেছেন, অন্যজন এঁকেছেন। সবাই নিজেদের অনুভূতি ভাগাভাগি করেছেন এদিন। লেখা ও আঁকায় একটি পূর্ণাঙ্গ ভালো শিশুতোষ বই তৈরিতে লেখক, শিল্পী, প্রকাশকের ভূমিকা নিয়ে অনেকক্ষণ চলল আলাপ–আলোচনা।
৪ মে ও আজ ৬ মে বিকেল চারটায় প্রদর্শনীতে শিশুরা নিজের লেখা গল্প পড়েছে, ইকরিমিকরির বই থেকেও গল্প পড়ে শুনিয়েছে। আজ বিকেল পাঁচটায় কীভাবে সহজে বই বানানো যায়, এমন এক কর্মশালায় অংশ নিয়েছে একঝাঁক শিশু।
কর্মশালা করিয়েছেন শিল্পী শামীম আহমেদ। আর বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত শিল্পী সব্যসাচী মিস্ত্রী করিয়েছেন ‘শব্দ থেকে ছবি’র কর্মশালা। এতে অংশ নিয়েছেন ফাইন আর্টসে অধ্যয়নরত বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়ারা। ৫ মে বিকেল পাঁচটায় টাইপোগ্রাফি নিয়ে কর্মশালা করিয়েছেন শিল্পী দেওয়ান আতিকুর রহমান।
৩ মে বিকেলে গ্যালারির পশ্চিম পাশে, যেখানে বসে শিশুরা মনের সুখে ছবি আঁকছিল, তার ঠিক পাশেই দেয়ালে ঝুলছিল শিল্পী নিখিল চন্দ্র দাসের হাতে আঁকা বেশ কিছু পটের ছবি। এসব ছবি অলংকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে ইকরিমিকরির বই ‘জিরোধ্বনী’র পাতায় পাতায়। সেই ‘জিরোধ্বনী’ বইটি দেয়ালে ঝোলানো ছবিগুলোর নিচে জ্বলজ্বল করছিল। পাশাপাশি ছবির বই, বইয়ের ছবি দেখে মনে হচ্ছিল যেন চিরকালের বন্ধু ওরা।
আগামীকাল ৭ মে প্রদর্শনীর শেষ দিন। সন্ধ্যা সাতটায় মঞ্চস্থ হবে নাটক ‘ফাংসাং’। নাট্যদল ‘বটতলা’র খুদে অভিনয়শিল্পীরা নাটকটিতে অভিনয় করবে। সেদিন কেউ ফাংসাং হবে, কেউ ফাংসাং গল্পের পাখি হবে, কাঠবিড়ালি হবে। চাইলে আপনিও বাড়ির ছোটদের নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন চমৎকার প্রদর্শনীটি থেকে।