বিনা মূল্যের জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী ও টিকা কেন টাকা দিয়ে কিনতে হবে

নন্দীপাড়ায় নারী ও কিশোরীদের মুখোমুখি হয়েছিলেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তারা
ছবি: প্রথম আলো

সেতু রানী মণ্ডল (৪০) রাজধানীর খিলগাঁওয়ের নন্দীপাড়া এলাকার পুরোনো বাসিন্দা। তাঁর দুই মেয়ে, এক ছেলে। স্বামী রংমিস্ত্রি। দীর্ঘদিন ধরেই জন্মনিয়ন্ত্রণে খাবার বড়ি ব্যবহার করে আসছেন তিনি। পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকার কাছ থেকে বিনা মূল্যে মাস হিসেবে এক প্যাকেট নিতেন। তবে ছয় থেকে সাত মাস ধরে সরকারি সেবাদানে নিয়োজিত বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে ২০ টাকা দাম দিয়ে প্যাকেট কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। তাঁর প্রশ্ন হঠাৎ করেই কেন তাঁকে টাকা দিয়ে সরকারি বড়ি কিনতে হচ্ছে? সেতু রানীর সঙ্গে উপস্থিত আরও দুই নারীও বললেন, তাঁদেরও এখন সরকারি খাবার বড়ি ও কনডম টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। তাঁরা বললেন, জন্মনিয়ন্ত্রণে তিন মাসের স্বল্পমেয়াদি ইনজেকশন নিতেও ৫০ টাকা করে দিতে হয়। গত ২৮ নভেম্বর নন্দীপাড়ার শেরে বাংলা আইডিয়াল ইনস্টিটিটউটে একশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত এক সভায় এসব অভিযোগ করেন তারা। ‘সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ও জনসংযোগ সভা ২০২২’ শিরোনামে আয়োজিত সভায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তারা নারী ও কিশোরীদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। এ সময় বিনা মূল্যের সরকারি সেবা না পাওয়া, কোনো কোনো সেবা পেতে অতিরিক্ত টাকা দেওয়া এবং এলাকার নানা সমস্যা নিয়ে অভিযোগ করেন নারী ও কিশোরীরা।

নন্দীপাড়া এলাকাটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৭৪ নম্বর ওয়ার্ড। সরেজমিনে এলাকাটির নারী ও কিশোরীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেখানে সরকারের বিনা মূল্যের জন্মনিয়ন্ত্রণ সেবা, কিশোরীদের টিটি টিকা, শিশুদের টিকার সবকিছুই টাকা দিয়ে কিনতে হয়। স্বল্প মূল্যের জন্মনিবন্ধন সেবা নিতে হয় ১৬ গুণ পর্যন্ত বেশি দামে।

অবসরপ্রাপ্ত পরিবার কল্যাণ সহকারী শিউলি আক্তার, ওই পদে যোগ দেওয়া তাসনুভা এবং জনপ্রতিনিধির কাছ থেকেও এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। শিউলি আক্তার বলেন, ৩১ বছর বিনা মূল্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ সেবা দিয়েছেন তিনি। এখন কেন টাকা লাগছে? তাসনুভা বলেন, তিনি একবার এক নারীকে বিনা মূল্যে ইনজেকশন দেওয়ার জন্য নন্দীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডেকেছিলেন। বেসরকারি সংস্থার লোকজন তাঁর উপস্থিতি ভালোভাবে নেননি।

কিশোরীদের টিটি টিকা টাকা দিয়ে কিনতে হবে কেন?
ছবি: প্রথম আলো

ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. আজিজুল হক বলেন, টাকা নেওয়ার বিষয়টি একবার তাঁর নজরে পড়লে তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।

টিকা নিতেও টাকা

ধনুষ্টংকার রোধে ১৫ বছরের বেশি বয়সী কিশোরীদের জন্য সরকারের চার ডোজের বিনা মূল্যের টিটি টিকা কর্মসূচি রয়েছে। নন্দীপাড়ার খুশি ইসলাম ২০১৬ সালে কিশোরী অবস্থায় বিনা মূল্যে চার ডোজ টিকা নেন। তবে একই এলাকার কিশোরী তৃষ্ণা রানীর (১৬) অভিভাবককে গত নভেম্বর মাসে টিটি টিকার জন্য ১০০ টাকা দিয়ে কার্ড করতে হয়েছে। প্রথম ডোজ নিতে খরচ হয়েছে আরও ৫০ টাকা।

শিশুসন্তান রয়েছে এমন দুই নারী কনিকা রানী মণ্ডল ও আয়েশা আক্তার জানান, শিশুদের টিকা দিতেও টাকা নেওয়া হয়।

জন্মনিবন্ধন নিয়েও তাঁদের ক্ষোভ রয়েছে। কনিকা জানান, তাঁর চার বছরের মেয়ের জন্মনিবন্ধন করতে খরচ হয়েছে ৮০০ টাকা। সেতু রানীর পাঁচ বছরের ছেলের জন্মনিবন্ধনে খরচ হয়েছে ৫০০ টাকা। অথচ পাঁচ বছরের নিচের বয়সী ও পাঁচ বছরের বেশি বয়সী শিশুদের জন্মনিবন্ধনে সরকারি ফি যথাক্রমে ২৫ টাকা ও ৫০ টাকা। জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্মনিবন্ধন করলে কোনো ফি নেওয়া হয় না।

উন্নয়ন সংস্থা একশনএইড বাংলাদেশ এ বছর ‘স্পৃহা বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে নন্দীপাড়া এলাকায় জেন্ডার সংবেদনশীল জনসেবা বিষয়ে একটি সামাজিক নিরীক্ষা করে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, শিশু ও কিশোরীদের বিনা মূল্যের টিকা টাকা দিয়ে কিনতে হয় বলে অনেক দরিদ্র পরিবার শিশুদের সময়মতো টিকা দেয় না। কিশোর–কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য ও বয়োঃসন্ধিকালীন পরামর্শ এবং গর্ভবতী মায়েদের সন্তান প্রসবের আগে পরে সেবা নেওয়ার জন্য কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। সরকারি মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সাত কিলোমিটার দূরে। গর্ভবতী মায়েদের সন্তান প্রসবের জন্য বাসাবো এবং বনশ্রীর বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যেতে হয়, খরচ হয় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা।

কর্মকর্তারা যা বললেন

বিনা মূল্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ সেবা না পাওয়ার বিষয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ফিল্ড সার্ভিসেস ডেলিভারি ইউনিটের (মাঠপর্যায়ে সেবা ও সরবরাহ ইউনিট) লাইন পরিচালক নিয়াজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নগরে বিনা মূল্যের এই সেবা নিয়ে বৈষম্য রয়েছে। এর সমাধান হওয়া উচিত। নগরের বাইরে এই সেবা বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। ঢাকায় অধিদপ্তরের বিশেষায়িত তিনটি হাসপাতালে এই সেবা বিনা মূল্যের। এর বাইরে নগরে সিটি করপোরেশন সেবা দেয়।

ঢাকায় দুটি সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ নগরাঞ্চলে বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়। সংস্থাগুলো ‘অন্যান্য সেবা দেওয়া হয়’ উল্লেখ করে টাকা নেয়।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জনবলের অভাবে এসব সেবার দায়িত্ব বেসরকারি সংস্থাকে দেওয়া হয়েছে। জন্মনিয়ন্ত্রণের সেবায় কোনো টাকা নেওয়ার নিয়ম নেই। পরিবহন, সরবরাহে কিছু খরচ থাকায় টিকার ক্ষেত্রে সংস্থাগুলোকে ন্যূনতম ফি (৫০ টাকার বেশি নয়) নিতে বলা হয়েছে।

ঢাকায় ১, ২, ৩, ১২, ৭৪ ও ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডে সেবা দেয় বেসরকারি সংস্থা সীমান্তিক। সংস্থার খিলগাঁও অঞ্চলের প্রকল্প ব্যবস্থাপক নাজমুন নাহার বিনা মূল্যের সেবায় টাকা নেওয়া হয় না দাবি করে বলেন, সেবা নিতে আসা নারী ও কিশোরীদের অতিরিক্ত কিছু সেবা দেওয়া হয়, সেটার জন্য সার্ভিস চার্জ নেওয়া হয়।

একশনএইড বাংলাদেশের প্রতিবেদনটিতে অন্তঃসত্ত্বা ও দুগ্ধদানকারী মা, কিশোর–কিশোরীদের বয়োঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, বিনা মূল্যের টিকা পাওয়া, জন্মনিবন্ধনে অতিরিক্ত টাকা না নেওয়া, সামাজিক ভাতা ও যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি, এলাকার পানিসংকট সমাধানে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়।