কানাডার স্যাটেলাইট গবেষক দলে নর্থ সাউথের সামিহা

ঢাকার নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশনে স্নাতক করেছেন সামিহা
ছবি: সংগৃহীত

কানাডার ইউনিভার্সিটি অব নিউ ব্রান্সউইকের শিক্ষার্থীরা তৈরি করেছেন ভায়োলেট নামের এক কৃত্রিম উপগ্রহ, যার মূল কাজ হবে আবহাওয়া সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। এই দলে ছিলেন বাংলাদেশের মেয়ে সামিহা লুবাবা খান। ঢাকার নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশনে স্নাতক করা সামিহা কীভাবে এই প্রকল্পে যুক্ত হলেন?

বিদায় ভায়োলেট

নভেম্বর ২৫, ২০২৩। কানাডার নিউ ব্রান্সউইক থেকে কিউবেকের দিকে চলেছেন ড. ব্রেন্ট পিটারসেন ও তাঁর দল। এই দলে আছেন সামিহাও। ভায়োলেট নামের স্যাটেলাইটটি তাঁরা তুলে দেবেন কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সির হাতে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা পেরিয়ে সেখান থেকে ভায়োলেটকে পাঠানো হবে মহাশূন্যে। ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের মাধ্যমে এটি চলে যাবে পৃথিবীর কক্ষপথে।

রকেটে চড়ে কক্ষপথে যাবে ভায়োলেট। পথের ধকল সামলে সে ঠিকঠাক কাজ করবে কি না, তার জন্য দরকার ভাইব্রেশন টেস্ট। কিংবা ভায়োলেট আসলে রকেটের মাপে বসবে কি না, সেটাও পরীক্ষা হবে। একটু এদিক-সেদিক হলে যাত্রা বাতিল। কিছু পরীক্ষা আগেই করা ছিল। তবু কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সির চূড়ান্ত পরীক্ষায় পাস করা চাই।

দু-তিন দিনের মধ্যেই সব পরীক্ষা পার হলো ভায়োলেট। কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সির হাতে তাকে তুলে দিল সামিহাদের দল। ভায়োলেট এখন মহাশূন্যে যাওয়ার জন্য তৈরি। দলের সবার মধ্যে স্বস্তি মেশানো গর্ব। কিন্তু একটু মন খারাপও। কেন?

‘ভায়োলেট আজ থেকে আর আমাদের সঙ্গে নেই। এটা ভেবেই কেমন যেন একটু মন খারাপও হচ্ছিল।’

গবেষকদলের সঙ্গে সামিহা (বাঁয়ে)
ছবি: সংগৃহীত

সাই-ফাই সিনেমার মতো

২০২৩ সালের আগস্ট ভায়োলেট স্যাটেলাইট তৈরির দলে যোগ দেন সামিহা। নিউ ব্রান্সউইক প্রদেশের নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী কোনো না কোনো পর্যায়ে যুক্ত ছিলেন এ প্রকল্পে।

কিউবস্যাট নামের প্রকল্পটির অর্থায়ন করেছে কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি। কানাডার প্রতিটি প্রদেশের জন্য একটি করে স্যাটেলাইট থাকবে। বানাবেন শিক্ষার্থীরা। ভবিষ্যতে তাঁরা যেন মহাকাশবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করতে উৎসাহী হন, এই ছিল প্রকল্পটির উদ্দেশ্য। প্রায় সব কটি প্রদেশের স্যাটেলাইটই মহাশূন্যে চলে গেছে। মার্চ মাসের শুরুর দিকে রওনা দিয়েছে ভায়োলেট।

কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সিতে প্রথম প্রবেশের দিনটা কখনো ভুলবেন না সামিহা। কিউবেকের সেন্ট হুবার্ট এলাকায় এর অবস্থান। অনেক দূর থেকেই গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে যেতে হয়।

‘কয়েক ধাপের চেকিং পার হয়ে ঢুকলাম। সিনেমায় যেমন দেখায় স্পেস এজেন্সি, একদম তেমন। তবে আমার মাথায় তখনো ঘুরছিল, ভায়োলেট কখন হস্তান্তরিত হবে। দ্বিতীয় দিন গিয়ে দেখি, কোথাও কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছেন মহাকাশচারীরা। আমাদের জানানো হলো, সব পরীক্ষায় মোটামুটি উতরে যাচ্ছে ভায়োলেট। এদিন আমাদের স্পেস এজেন্সির ভেতরটা ঘুরিয়ে দেখানো হলো। দেখতে পেলাম, সরাসরি যোগাযোগ হচ্ছে নানা স্যাটেলাইটের সঙ্গে। একগাদা মনিটরে তথ্য ধারণ করা হচ্ছে। একজন মহাকাশচারীকে দেখলাম স্পেস স্যুট পরে আছেন। এসেছিলেন কানাডিয়ান গণমাধ্যমের সাংবাদিকেরাও,’ বলছিলেন সামিহা। এ নিয়ে প্রতিবেদন হয়েছে কানাডার সিবিসিসহ বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে।

কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সির ভেতরটা ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছেন সামিহারা
ছবি: সংগৃহীত

রূপকথা থেকে মহাকাশ অবধি

নর্থ সাউথ থেকে স্নাতকের পর কিছুদিন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছিলেন সামিহা। তারপর তড়িৎপ্রকৌশল পড়তে চলে যান কানাডা।

বাংলাদেশের একমাত্র স্যাটেলাইটটির কথা সামিহার জানা। তবে এ নিয়ে কিছুটা আক্ষেপও আছে, ‘কানাডায় প্রতিটি প্রদেশ থেকে স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছে। আমাদের দেশের হয়ে মাত্র একটা। হয়তো সামনে আরও কয়েকটি স্যাটেলাইট দেখতে পাব আমরা।’

আরও পড়ুন

হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস আর ‘তিন গোয়েন্দা’ দিয়ে বই পড়া শুরু। পরে গ্রিক পুরানের দিকে ঝোঁকেন সামিহা। ‘ওখানে গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে যা আছে, পড়তে ভীষণ ভালো লাগত। মহাকাশ নিয়ে আগ্রহের শুরুটা হয়তো সেখান থেকেই। রূপকথাও পড়তাম খুব। তারপর কাজ করতে শুরু করে এগুলো বুঝতে শুরু করলাম। আকাশ দেখতে আমার ভালো লাগে।’

মাল্টিফাংশনাল স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন নিয়ে গবেষণা করছেন। ভায়োলেটের পর এতেই মনোযোগী হবেন। সেই সঙ্গে আছে মহাকাশচারী হওয়ার ইচ্ছাও। ‘যতটা মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি লাগে এর জন্য, তা নিতে রাজি আছি,’ বলেন তিনি।

কানাডায় স্থায়ী হওয়া কিংবা মহাকাশে পাড়ি দেওয়া, এসবের মধ্যেও আর একটা বিষয় ভাবায় সামিহাকে—বাংলাদেশে ফিরে কাজ করা। বাবা রফিকুল ইসলাম খান, মা সালমা খান আর দুই বোনকে ছেড়ে থাকাটা কখনো কখনো মনে হয় অসম্ভব। কিছুদিন আগেই তাই ঘুরে গেছেন বাংলাদেশ থেকে।

ভায়োলেটের জন্য ভালোবাসা

এখন সামিহার প্রথম কাজ ভায়োলেটের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করা। শিগগিরই কক্ষপথে জায়গা করে নিয়ে তথ্য পাঠানো শুরু করার কথা। তবে মে মাসের শুরু পর্যন্ত যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। কৃত্রিম উপগ্রহটির নিউ ব্রান্সউইকের আকাশেই ঘোরাফেরা করার কথা। ‘ভায়োলেট আকাশে থাকবে দেড় থেকে দুই বছর। যেকোনো দিন তার সাড়া মিলবে। আমরা সেই অপেক্ষায় আছি,’ বলেন সামিহা।

দূর আকাশের তারা দেখতে ভালোবাসেন এই প্রকৌশলী। ছাদখোলা একটা গাড়ি কিনে তারা দেখে বেড়াবেন অবসরে, এমনই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। তত দিনে হয়তো মহাকাশের আবর্জনা বা ‘স্পেস জাংক’-এ পরিণত হবে ভায়োলেট। তবু সামিহার মনে পড়বে ভায়োলেটের কথা।