আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশি রোবটের জয়

রোবট অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ দল
ছবি: সংগৃহীত

রোবটের সঙ্গে আমার পরিচয় মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা বিজ্ঞান কল্পকাহিনি ‘কপোট্রনিক সুখ দুঃখ’ দিয়ে, আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে। সেটাই মাথার মধ্যে আছে। ১৯ নভেম্বর যখন জানা গেল বাংলাদেশের দুটি দল জার্মানির ডর্টমুন্ড শহরে হয়ে যাওয়া ২৪তম ওয়ার্ল্ড রোবট অলিম্পিয়াডে (ডব্লিউআরও) তৃতীয় (ব্রোঞ্জ পদক) ও ৮ম হয়েছে, তখন প্রথমই জাফর স্যারকে ফোন করলাম।

‘একসময় আমরা শুধু রোবটের গল্প পড়তাম বা লিখতাম। আমরা জানতাম আমাদের শুধু রোবটের গল্পই শুনতে হবে, বানানো আর হবে না। কিন্তু আমাদের শিক্ষার্থীরা আমাদের সেই ভুল ভেঙে দিচ্ছে। তারা শুধু যে রোবট বানাচ্ছে, তা নয়, বিশ্ব রোবট অলিম্পিয়াডের আসরে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণও দিয়ে যাচ্ছে’—এভাবেই নিজের অনুভূতির কথা তুলে ধরেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। জানিয়ে রাখি, বিশ্বের ৭৩ দেশের ৩৭৫টি দলের প্রায় ১ হাজার ৩০০–এর বেশি প্রতিযোগী এই অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়েছে।

অ্যাডভান্স ক্যাটাগরি ফিউচার ইঞ্জিনিয়ার্স ক্যাটাগরিতে অংশ নেয় ১৪ থেকে ১৯ বছর বয়সীরা। যারা শুধু একটি রোবটই বানায় না, তাদের রোবটটি বানানোর বিভিন্ন ধাপের ডকুমেন্টেশনও (তথ্য সংরক্ষণ) করতে হয়। উদ্দেশ্য হলো—ভবিষ্যৎ প্রকৌশলীদের রোবট তৈরির ধাপগুলোর সঙ্গে পরিচিত করানো। এ বছরের চ্যালেঞ্জ ছিল—দলগুলোকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন এমন একটি অটোনোমাস ভেহিকল বানাতে হবে, যা কালো রঙের দেয়ালে ঘেরা একটি ট্র্যাকের মধ্যে লাল ও সবুজ দুই ধরনের বাধাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করবে। লাল বাধাটি ডানদিক থেকে ও সবুজ বাধাটিকে বাঁদিক থেকে অতিক্রম করবে। এই বাধা অতিক্রম করে পুরো ট্র্যাকটি তিনবার ঘুরে এসে যেখান থেকে শুরু করেছে, ঠিক সেখানে থামতে হবে। ট্র্যাকের ওপরের নীল ও কমলা রঙের দাগ গুনে ঘোরার সংখ্যা বের করতে হবে। আর এতকিছু রোবটটিকে করতে হবে নিজে নিজে। এই ক্যাটাগরিতে প্রতিটি দেশ থেকে একটি করে দল অংশ নেয়।

টিম লেজি-গো দলের সদস্যরা ছিল বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের তথ্য ও যোগাযোগ প্রকৌশল (আইসিই) বিভাগের ছাত্র ইকবাল সামিন এবং ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির সফটওয়্যার প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র তওসিফ সামিন। বাংলাদেশি প্রযুক্তিতে তৈরি তাঁদের রোবট গাড়িটি বিভিন্ন রঙের বাধা ও দেয়াল শনাক্ত করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন একটি ক্যামেরা ব্যবহার করে এবং রং অনুযায়ী সেগুলো এড়িয়ে যায়। প্রথম দিন মহড়ার সময় ইকবাল ও তওসিফের রোবটটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দ্বিতীয় দিন শেষে কোয়ালিফাইং রাউন্ডে শতভাগ স্কোর নিয়ে তাঁরা ফাইনালে উত্তীর্ণ হয়। ফাইনালে চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক প্রতিযোগিতায় ৭৩ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় স্থান পায় টিম লেজি-গো। এই ক্যাটাগরিতে দ্বিতীয়—যুক্তরাষ্ট্রের পয়েন্ট ৭৪ ও প্রথম হওয়া তাইওয়ানের দলটির পয়েন্ট ছিল ৭৫।

ইকবাল সামিন বলছিলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুতি নিলেও একসময় মনে হচ্ছিল ফান্ডের অভাবে জাতীয় আয়োজনই হবে না। তারপর সেটা হওয়ার পর দেখা গেল পৃষ্ঠপোষকতা তো নেই–ই, এমনকি ভিসা পাওয়ার সম্ভাবনাও কম। এত জটিলতা কাটিয়ে আমরা শেষ পর্যন্ত বিশ্ব আসরে উপস্থিত হতে পেরেছি, নিজেদের তুলে ধরতে পেরেছি।’

বাংলাদেশের অন্য দলটি অংশ নিয়েছে ফিউচার ইনোভেটরস ক্যাটাগরিতে, যেখানে তাঁদের ‘মাই রোবট মাই ফ্রেন্ড’ অর্থাৎ ‘আমার রোবট, আমার বন্ধু’ থিমের ওপর রোবট তৈরি করতে হয়েছে। টিম রোবনিয়াম বাংলাদেশ দলটিতে ছিল রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের এসএসসি পরীক্ষার্থী ইসরাফিল শাহীন এবং মণিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র মীর মুহাম্মদ আবিদুল হক।

স্কুলের টেস্ট পরীক্ষার প্রস্তুতিকালে ‘বাংলা সাহিত্য’ বইয়ের ‘সুভা’ গল্পটি ইসরাফিল শাহীনের মনে দাগ কাটে। ‘এমন কিছু কী করা যায়, যাতে একজন বাক্‌ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী মানুষও আমাদের সঙ্গে সহজেই মনের ভাববিনিময় করতে পারে?’—এমন ভাবনা থেকেই তার রোবট তৈরির চেষ্টা। ইশারা ভাষা এবং ইশারা ভাষা শনাক্তকরণ অ্যালগরিদমের ব্যাপারটি বুঝে নিয়ে টিমমেট আহনাফের সঙ্গে মিলে একটি ভার্চ্যুয়াল রোবট তৈরি করে সে। শাহীন বলল, ‘এই রোবটটিকে ভার্চ্যুয়াল থেকে ফিজিকাল রোবটে পরিণত করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। কারণ, অনেক যান্ত্রিক, ইলেকট্রনিক ও সফটওয়্যার চ্যালেঞ্জের সমাধান করতে হয়েছে।’ টিম রোবনিয়ামের বানানো ডিফড্রয়েড বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির যোগাযোগ সহযোগী হিসেবে কাজ করে। তাদের রোবট হয়ে ওঠে বাকপ্রতিবন্ধী মানুষের বন্ধু। ২০টি দেশের ৩২টি দলের সঙ্গে লড়ে শাহীনের এই ‘বন্ধু’ ২০০ নম্বরের মধ্যে ১৯২ দশমিক ২৫ পয়েন্ট জিতে অষ্টম হয়েছে।

বাংলাদেশের দুটি দলই দেশে ডিজাইন করা জেআরসি বোর্ড ব্যবহার করেছে। এই বোর্ডের অন্যতম ডিজাইনার মাহেরুল আজম কোরেশী উপদলনেতা হিসেবে দলের সঙ্গে ছিলেন। ‘দেশীয় বোর্ড নিয়ে প্রথমবারের মতো একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার চ্যালেঞ্জটা মোটেও সহজ ছিল না। কারণ, অন্যরা সবাই বিশ্বের পরিচিত বোর্ড ও উপকরণ ব্যবহার করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা পেরেছি,’ বললেন তিনি।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ওয়ার্ল্ড রোবট অলিম্পিয়াডের আয়োজক বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (বিডিওএসএন)। এবারের আয়োজনে টাইটেল স্পন্সর হিসেবে সহায়তা করেছে ক্রিয়েটিভ আইটি ইনস্টিটিউট। সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশ কম্পিউটার সার্ভিসেস লিমিটেড, জেআরসি বোর্ড ও ম্যাসল্যাব। জাতীয় আয়োজনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে।