সান্না মারিন
ছবি: সংগৃহীত

প্রিয় স্নাতকেরা, আজ এই বিশেষ দিনে তোমাদের কী-ই বা বলতে পারি? আজ তোমরা স্নাতক হচ্ছ। এক দিকে যেমন তোমাদের জীবনের একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি হচ্ছে, তেমনি আরেকটা অধ্যায় আছে শুরুর অপেক্ষায়। এটা নিশ্চয়ই তোমাদের জীবনের একটা ‘টার্নিং পয়েন্ট’, একটা পরিবর্তনের সূচনা।

তাই মনে হলো, ‘পরিবর্তন’ নিয়ে কথা বলার জন্য আজ একটা ভালো দিন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আজ আমি এ বিষয়ে কিছু কথা বলব। ৩৪ বছর বয়সে যখন পৃথিবীর সবচেয়ে কমবয়সী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হলাম, তখন থেকে দুটো প্রশ্ন আমি সবচেয়ে বেশি শুনেছি। দুটোই পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রথম প্রশ্ন—তুমি কি সব সময় প্রধানমন্ত্রীই হতে চেয়েছিলে? দ্বিতীয় প্রশ্ন—কীভাবে এটা সম্ভব হলো? এ ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি যদি তোমাকেও ভবিষ্যতে হতে হয়, তুমি কী উত্তর দেবে? সে পরামর্শই আজ দেওয়ার চেষ্টা করব।

প্রথম প্রশ্নে আমার উত্তর হলো, আমি কখনোই রাজনীতিবিদ বা প্রধানমন্ত্রী হতে চাইনি। এটা কখনোই আমার পরিকল্পনায় ছিল না। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হলো, পরিবর্তন আনতে চেয়েছি বলেই আজ আমি প্রধানমন্ত্রী।

আমি পৃথিবী বদলাতে চেয়েছি এবং এ-ও উপলব্ধি করেছি, এই দায়িত্ব অন্য কারও নয়।

পরিবর্তন আনো

আমি জানি, আমি একটু বেশি বলে ফেলছি। তোমরা যেহেতু এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করেছ, তোমাদের অত সব লেকচারের প্রয়োজন নেই। কিন্তু তবু তোমাদের জানার সঙ্গে আরও একটু যোগ করতে চাই। পরিবর্তন সম্পর্কে আজ তোমাদের তিনটি উপদেশ দেব। এক. চাওয়ার অধিকার তোমার আছে। তুমি পরিবর্তন চাইতেই পারো। দুই. চাওয়াই যথেষ্ট নয়। পরিবর্তন করতে হলে তোমাকেই চালকের আসনে বসতে হবে। তিন. ভয় পেয়ো না।

সান্না মারিন
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

আমার বয়স যখন তোমাদের মতো, সবে ২০ পেরিয়েছি, সে সময় আমি রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হতে শুরু করি। নীতি নির্ধারণের প্রক্রিয়া, নির্বাচিত রাজনীতিবিদ হওয়া—এসব নয়। আশপাশে তাকিয়ে যেসব বিষয়ে পরিবর্তন আনা দরকার বলে আমার মনে হয়েছে, সেগুলোই ছিল আগ্রহের বিষয়। যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য হ্রাস, মানবাধিকার, সংখ্যালঘুদের অধিকার, লিঙ্গসমতা ইত্যাদি। আমি জানি, তোমাদের অনেকের চিন্তাভাবনাও আমার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।

আমি সব লিঙ্গের মানুষের জন্য সম–অধিকার চেয়েছি। নারী ও পুরুষের বেতনের অসামঞ্জস্য দূর করতে চেয়েছি। আমি চেয়েছি, পরিবারে মা ও বাবা উভয়ই সমান ভূমিকা রাখুক, যেন একজন নারীও পুরুষের মতোই তাঁর ক্যারিয়ারের লক্ষ্য পূরণের পেছনে সময় দিতে পারে।

উত্তর ইউরোপের একটা দেশ হিসেবে ফিনল্যান্ডের প্রকৃতি অনন্য। জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করে আমি সমাজকে আরও টেকসই করতে চেয়েছি। আমি এমন একটা সমাজ চেয়েছি, যেখানে সবার অধিকার সমান। আমি চেয়েছি একটা শক্তিশালী শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে প্রত্যেক শিশু তার স্বপ্নের পেছনে ছুটতে পারবে। এসব পরিবর্তন চেয়েছি বলেই আমাকে রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে হয়েছে, নির্বাচনে দাঁড়াতে হয়েছে। ইচ্ছা ছাড়া কোনো পরিবর্তনই সম্ভব নয়। সে জন্যই আজ আমার প্রথম উপদেশ, পরিবর্তন আনো।

দায়িত্ব তোমারই

পৃথিবী এখন অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি জটিল। ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন আসছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র্য হ্রাস আমাদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলছে। ডিজিটালাইজেশন আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থান সমাজে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে, সেটাও আমরা টের পাচ্ছি। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা দরকার। আর সেই কাজ তুমি ছাড়া কেউ করবে না।

গত কয়েক দশকে পৃথিবী নিয়ে আমরা আরও আশাবাদী হয়েছি। বাক্স্বাধীনতা, আইনের শাসন, লিঙ্গসমতা, গণতন্ত্রের মতো মূল্যবোধে বিশ্বাস রেখেছি। আমরা ভেবেছিলাম, বিশ্বায়ন ও উন্নয়ন সবার কাজে আসবে। কর্তৃত্ববাদী শাসন কমবে, বৈচিত্র্য আরও গুরুত্ব পাবে। গায়ের রং, লিঙ্গ, ধর্ম কারও জন্য বাধা হবে না। আমরা আশা করেছিলাম, তথ্যের স্বাধীনতা ও ইন্টারনেট মানুষকে বিকশিত করবে।

কিন্তু ইতিহাস এখনো শেষ হয়ে যায়নি। পৃথিবীর সর্বত্রই দেখছি, বাক্স্বাধীনতার মতো যেসব বিষয় গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি, সেগুলোই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। কখনো সত্যের সঙ্গে মিথ্যা মিশে যাচ্ছে। কখনো আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করা হচ্ছে। সারা বিশ্বেই লিঙ্গসমতা আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। খোদ ইউরোপেও নিরাপদ গর্ভপাতের অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। সমস্যার আইসবার্গের (হিমশৈল) একদম চূড়ায় আমরা কেবল যুদ্ধ আর ক্ষমতার দ্বন্দ্বটাই দেখতে পাচ্ছি। বিশ্বযুদ্ধের পর আমরা যে আন্তর্জাতিক নীতি তৈরি করেছিলাম, ইউক্রেনে হামলা করে রাশিয়া সেই নীতি ভঙ্গ করেছে। অন্য সব আইনকেও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এখানে যুদ্ধটা মূল্যবোধের। আর সেই যুদ্ধে আমাদের সবাইকেই কোনো না কোনো পক্ষ নিতে হবে। এখানে মধ্যপন্থা বলে কিছু নেই।

আরও পড়ুন

তোমার মতো বয়সে আমি ভাবতাম ছুটি বলে কিছু নেই: বিল গেটস

আরও পড়ুন

‘কিন্তু গানটা গাইতে গিয়ে যা হওয়ার তা–ই হলো...’

ভয়কে জয়

সবুজবান্ধব প্রযুক্তি আর ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বদলে দেওয়ার সব দক্ষতাই তোমাদের আছে। শুধু টেকসই উন্নয়নই নয়, এমন উদ্ভাবনেও ভূমিকা রাখতে পারো, যা সারা পৃথিবী অনুসরণ করবে। আমি নিশ্চিত যে ডিজিটালাইজেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম বিজ্ঞান আমাদের সমাজে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে, তা তোমরা আমার চেয়ে অনেক ভালো জানো। গতকাল তোমাদের ক্যাম্পাস ঘুরে আমি দেখেছি, তোমরা অত্যাধুনিক বিজ্ঞান, উদ্ভাবন, প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছ। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে নতুন প্রযুক্তিই আমাদের ভবিষ্যতের নকশা আঁকবে। কিন্তু একই সঙ্গে তোমাদের মতো মেধাবী মানুষও আমাদের লাগবে, যাঁরা এই সব প্রযুক্তি মানুষের উপকারে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করবে। বিশ্বাস করো, তুমি পারবে।

প্রশ্ন হলো, কীভাবে? যখন আমি আমার তরুণ বয়স, শুরুর দিকের পেশাজীবনের দিকে ফিরে তাকাই, তখন বুঝতে পারি, ভয় মানুষকে আটকে রাখে। যথেষ্ট না জানার ভয়, লজ্জিত হওয়ার ভয়, ভুল করার ভয়, সবার সঙ্গে তাল মেলাতে না পারার ভয়, প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারার ভয়। আমি দেখতে ভালো না, সুন্দর করে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারি না, ভালোভাবে কথা বলতে পারি না—এই ভয়ও তোমার থাকতে পারে। সৌভাগ্যক্রমে এবং অপ্রত্যাশিতভাবে পৃথিবীতে এমন কোনো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নেই, পরিবর্তন আনতে হলে যার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। যদি আমি কারও অনুমতির অপেক্ষায় থাকতাম, তাহলে এখনো হয়তো অপেক্ষাই করে যেতাম। তাই তোমাদের প্রতি আমার উপদেশ—ভয় পাওয়া বন্ধ করো।

আজ যখন এই স্টেডিয়াম ছেড়ে যাবে, আমার এই তিন উপদেশ মনে রেখো। (সংক্ষেপিত)

সূত্র: অনুষ্ঠানের ভিডিও