বাবার সঙ্গে সূর্য ‘আবিষ্কার’

আজ বাবা দিবস। বিশেষ এই দিনে বাবাকে নিয়ে লিখেছেন প্রথম আলোর পাঠকেরা। পড়ুন প্রকৌশলী নাদিরা মুসতারীর লেখা।

বাবার সঙ্গে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

বাবার সঙ্গে কোথাও ঘুরতে যাওয়াটা পরিশ্রমের কাজ ছিল। আমাদের বোনদের শখ ছিল, ঘুরতে গেলে একটু বেলা করে উঠব। লাগোয়া বারান্দার ইজিচেয়ারে শরীর ছেড়ে দিয়ে কফির কাপে বুঁদ হব। কিন্তু সেই শখ বাড়িতেই ফেলে আসতে হতো, যদি সফরের উদ্যোক্তা হতেন বাবা। বাবার মতে, সুয্যিমামাকে হারিয়ে যদি তার আগে ওঠা যায়, তবেই তো সফরের আসল মজা! ফলস্বরূপ, কেতাদুরস্ত বাবার পিছে পিছে আমরা বোনেরা কোনোরকমে ঘরের কাপড়ের ওপরই একটা শাল চড়িয়ে বেরিয়ে পড়তাম। চশমার ফাঁক গলে সূর্যের প্রথম রশ্মিটা ভেদ করামাত্র একটু নড়েচড়ে বসতাম। কেন যেন সূর্যটাকে বড় আপন লাগত। প্রতিদিন একই সূর্য ওঠে, অথচ এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সূর্য তো দেখা হয় না!

একবার এমনই এক ভোরে, আলোয় যখন চারপাশ মুক্তোর মতো জ্বলছে, আমরা বোনেরা চোখাচোখি করি—ঘুমের ঘোরে শাল মনে করে বিছানার চাদরটাই গায়ে পেঁচিয়ে নিয়েছি। কোনোমতে হোটেল রুমে ঢুকতে পারলেই এখন বাঁচি, এমন সময় হোটেলমালিকের সঙ্গে বাবার দেখা। আগের রাতে একটু কথা বলে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলেছেন দুজন। এখানে বলে রাখি, মানুষকে বশ করার অদ্ভুত একটা অস্ত্র বাবার আছে। দেখামাত্র জিজ্ঞেস করবেন, ‘বাড়ি কোথায়?’ আপনার বাড়ি বাংলাদেশের যে খণ্ডেই হোক না কেন, বাবা সেখানকার কাউকে না কাউকে চিনবেন। সেই নামটা বলামাত্র আপনার চোখ উজ্জ্বল হয়ে যাবে, আপনি জানতেও পারবেন না বাবার জাদুর থলের সবচেয়ে পুরোনো কৌশলের টোপে আটকে গেছেন।

আমরা আমাদের পোশাক কেলেঙ্কারি থেকে মুক্তি পেতে হোটেলের দিকে পা বাড়াতে যাব, এমন সময় পেছন থেকে বাবার ডাক, ‘আয় তো মা, তোদের আঙ্কেলের সঙ্গে একটা ছবি তুলে রাখি।’

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমাদের মাথায় অনেক রকমের দৃশ্যের অবতারণা হতে থাকে। আমরা চিন্তা করতে থাকি কী করে এই বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কিন্তু ভাগ্যদেবী অপ্রসন্ন। আমাদের বিছানার চাদর-জড়ানো ছবিটা হোটেলমালিকের ফোনের মেমোরিতে আজীবনের জন্য জায়গা করে নেয়।

আমার সহজ-সরল বাবা বুঝতেও পারেন না তাঁর মেয়েগুলো কেন ট্যুরের বাকিটা সময় মুখ গোমড়া করে রেখেছিল।

মুখ গোমড়া করার কারণ অবশ্য আরও ছিল। পেশায় চিকিৎসক বাবা কোথাও ঘুরতে গেলে আমাদের সবার ডায়েটের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ দিতেন। আমরা চাইতাম রাস্তার পাশের কার্টের ফুচকা-চটপটি খেতে, ফেরিতে উঠলেই আবদার করতাম ঝুড়ি মাথায় হাঁকতে থাকা মামার ঝুড়ির রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে। ট্রেনে উঠলেই কেন জানি না, চোখের সামনেই বানিয়ে দেওয়া ঝালমুড়ি আর ‘গ্রাম চা’র লোভ সামলাতে পারতাম না। কিন্তু বাবার সঙ্গে ঘুরতে গেলে এর সবকিছুতেই কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিল। বাসা থেকে নিয়ে আসা ডিমসেদ্ধতেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হতো। বাবার মতে, শরীরই যদি ফিট না থাকে, ঘুরবি কী করে!

এখন বড় হয়েছি। থাকি দেশের বাইরে। দেশ-বিদেশের কত কত সূর্যোদয় যে নিজের ঝুলিতে ভরেছি বাবার শিখিয়ে দেওয়া মন্ত্র অক্ষরে অক্ষরে পালন করে, তার আর হিসাব রাখা হয়নি।

বাবা, রোমাঞ্চের নেশাটা যেন সব সময় তোমাকে এভাবেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে, এ কামনাই করি।

আরও পড়ুন