বুয়েটিয়ান আমরা চার ভাই

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় বড় হয়েছেন চার ভাই—হাসান মনির, হাসান মুরাদ, হাসান মাসুম ও হাসান মামুন। চারজনই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) পড়েছেন বা পড়ছেন। কীভাবে একই পরিবারের চার ভাই বুয়েটে পড়ার সুযোগ পেলেন, কীভাবে তাঁরা নিজেদের প্রস্তুত করেছিলেন, এমন নানা প্রসঙ্গে লিখেছেন ছোট ভাই হাসান মামুন।

বাঁ থেকে হাসান মনির, হাসান মুরাদ, হাসান মাসুম ও হাসান মামুন
ছবি: সংগৃহীত

বুয়েটের সঙ্গে আমাদের ‘পারিবারিক সম্পর্ক’টা অন্তত আরও চার বছর বাড়ল। শুরুটা করেছিল বড় ভাইয়া, হাসান মনির। ২০০৯ সালে, ভাইয়া যখন বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় ৫৭তম হলো, কী যে খুশি হয়েছিল বাসার সবাই! তখনো জানতাম না, একে একে আমাদের চার ভাইকেই কাছে টেনে নেবে বুয়েট।

সেই ২০১০ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সব সময়ই আমাদের বাসার কেউ না কেউ বুয়েটে পড়ছে। এ বছর আমিও সুযোগ পেলাম। সেই সুবাদে আশা করছি, অন্তত ২০২৬ সাল পর্যন্ত বুয়েটে আমার আসা-যাওয়া থাকবে। একই পরিবারের সদস্যরা টানা ১৬-১৭ বছর ধরে বুয়েটে পড়ছে, এমন ঘটনা আর আছে কি না, জানা নেই।

আরও পড়ুন

বুয়েট থেকে স্নাতক শেষ করে আমার বড় ভাই হাসান মনির এখন ঢাকার মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে (এমআইএসটি) সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছে। পাশাপাশি বুয়েটে এমএসসি করছে। মেজ ভাই হাসান মুরাদ চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) প্রভাষক। বুয়েটে স্নাতক শেষ করে সেও এখন স্নাতকোত্তর করছে। সেজো ভাই হাসান মাসুম বুয়েটে তৃতীয় বর্ষে পড়ছে।

আমার বড় বোন আয়েশা সুলতানা একজন চিকিৎসক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস অ্যান্ড গাইনি বিভাগের মেডিকেল অফিসার, পাশাপাশি এমএস (ফেইজ ১) করছে। ছোট বোন আইমান সুলতানা এ বছর এসএসসি দেবে।

চার ভাই যেভাবে বুয়েটে

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা ইউনিয়নের ছাইনীপাড়া গ্রামে আমাদের বাড়ি। বাবা আমিনুর রহমান এখানকার কাটাখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মা আলেয়া বেগম গৃহিণী।

ছোটবেলা থেকেই আমরা ভাই-বোনেরা শুধু যে পাঠ্যবইয়ে মুখ গুঁজে থেকেছি, তা নয়। গ্রামে বড় হয়েছি। তাই খেলাধুলার প্রতি ঝোঁক ছিল সব সময়। বিশেষ করে আমরা ভাইয়েরা তো ক্রিকেটের পোকা। তবে এসবের পাশাপাশি পড়ালেখাটা যেন ঠিকমতো করি, সে জন্য আম্মু–আব্বুর কড়া নজর ছিল সব সময়। বিশেষ করে ক্লাস এইট পর্যন্ত। ছোটবেলায় সত্যি বলতে, বকা খাওয়ার ভয়ে পড়তে বসতাম। তবে নবম শ্রেণি থেকে আমরা ভাই-বোনেরা নিজের আগ্রহে পড়েছি।

হাসান মামুনের বড় বোন আয়েশা সুলতানা একজন চিকিৎসক
ছবি: সংগৃহীত

বাড়ির পাশের ছাইনীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে আমাদের ছয় ভাই–বোনের শিক্ষাজীবন। আমাদের চার ভাইয়ের কলেজও এক—চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজ।

আম্মু-আব্বু সব সময় চেয়েছেন, আমরা যেন ডাক্তারি পড়ি। কিন্তু আপু বাদে কেন যেন আর কেউই সে পথে হাঁটিনি। হয়তো চুয়েট ক্যাম্পাসের ভেতর স্কুল-কলেজ হওয়ায় প্রকৌশলের প্রতি একটা আলাদা টান ছিল। বুয়েটেই পড়তে হবে—বাসা থেকে এমন চাপ ছিল না কখনোই। আমরা যে যেটা পড়তে চেয়েছি, আম্মু-আব্বু তাতেই সায় দিয়েছে, সাহায্য করেছে।

চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মা আর সপ্তম-অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাবা ছিল আমাদের ‘প্রাইভেট টিউটর’। এরপর বিজ্ঞানের বিষয়গুলোয় বড় ভাইয়ারাই সাহায্য করেছে সব সময়। বাসায় টিচার রেখে পড়ার প্রয়োজন আমাদের কখনো হয়নি। শুধু স্কুল-কলেজে শিক্ষকদের কাছে ব্যাচে পড়েছি।

কেউ যখন প্রশ্ন করে, কীভাবে তোমরা চার ভাই-ই বুয়েটে ভর্তির সুযোগ পেলে, চমকপ্রদ কোনো উত্তর আমি দিতে পারি না। ভর্তি প্রস্তুতির কোনো ‘আশ্চর্য বটিকা’ আছে, এমন তো নয়। ছোটবেলা থেকে আমরা ভাই-বোনেরা সব সময় চেষ্টা করেছি, যেকোনো বিষয়ে আমাদের বেসিকটা (মূল ধারণা) যেন ঠিক থাকে। গণিতের প্রতি বাবা জোর দিয়েছেন সব সময়। আমরা তাই বুঝে বুঝে পড়ালেখা করেছি।

ভাইয়াদের পরামর্শ পেয়েছি, সাহায্য পেয়েছি, এটুকু সুবিধা তো ছিলই। করোনায় যখন সব বন্ধ হয়ে গেল, ভাইয়ারা বেশ কিছুদিন বাসায় ছিল। তখন বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে দিত। তাদের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করত। ভাইয়াদের পাশাপাশি কলেজের সিনিয়রদের কাছ থেকেও অনেক সাহায্য পেয়েছি।

আমি মনে করি, ভর্তি প্রস্তুতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো, আগের বছরের প্রশ্ন দেখে বারবার চর্চা করা। তাহলেই একটা ধারণা পাওয়া যায়।

বাড়তি চাপ

আমার সেজ ভাই হাসান মাসুমের কাছে শুনেছি, ভাইয়া যখন বুয়েটে ভর্তির সময় মেডিকেল টেস্ট দিতে গিয়েছিল, বড় দুই ভাই বুয়েটিয়ান শুনে চিকিৎসক বলছিলেন, ‘তুমি তো তাহলে খুব চাপে ছিলে।’

সেজ ভাইয়ার চেয়ে আমার ওপর চাপ তো ছিল আরও বেশি! বড় তিন ভাই বুয়েটে পড়েছে। সবাই ধরেই নিয়েছিলেন, আমিও বুয়েটে পড়তে যাচ্ছি। যদি ভর্তি হতে না পারি! যদি আমার বুয়েটে পড়া না হয়! এই ভয় ঘিরে ধরেছিল পরীক্ষার আগে। কিন্তু পরিবারের সবাই, শিক্ষক, বন্ধুরা মানসিকভাবে আমাকে সাহায্য করেছেন সব সময়। তাই চাপটা উতরে যেতে পেরেছি।

বড় ভাইয়া বুয়েটে টিকে যাওয়ার পর আমাদের সবার ওপর বাড়তি চাপ পড়েছে বলেই কি না কে জানে, ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে আমরা কেউ ভাইয়াকে টপকে যেতে পারিনি। বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় বড় ভাইয়া হয়েছিল ৫৭তম। মেজো ভাইয়া ৭৪তম, সেজ ভাই ৮০তম। আর আমি হয়েছি ৩২৪তম।

ভাইয়াদের দেখে এত দিন বুয়েটে পড়ার স্বপ্ন বুনেছি। এখন সত্যিই বুয়েটের মতো নতুন পরিবেশে নতুন বন্ধুদের সঙ্গে ক্লাস করতে পারব—ভেবেই রোমাঞ্চ বোধ করছি। অবশ্য ভাইয়ারাই বলেছে, বুয়েটে ভর্তি হতে পারা মানে চ্যালেঞ্জ কেবল শুরু। আরও অনেকটা পথ বাকি।