ছেলেদের পড়াশোনা করাতে কী কষ্টটাই না করেছেন এই মা, পেয়েছেন সরকারের শ্রেষ্ঠ সফল জননীর সম্মাননা
অভাবের সংসারে কী কষ্টটাই না একসময় করেছেন মেরিনা বেসরা। ছেলেদের পড়াশোনা চালু রাখতে অন্যের জমিতেও কাজ করেছেন। তাঁর তিন ছেলেই এখন প্রতিষ্ঠিত। এ বছর পেয়েছেন সরকারের শ্রেষ্ঠ সফল জননীর সম্মাননা। দিনাজপুরের বিরামপুরের এই মায়ের গল্প শোনাচ্ছেন রাজিউল ইসলাম
‘কষ্ট হয়েছে, খেয়ে না-খেয়ে থেকেছি, কিন্তু ছেলেদের পড়ালেখা বন্ধ করিনি। তিন ছেলেই এখন চাকরি করে। নাতি-নাতনিদের নিয়ে ভালোই আছি।’
ভালো যে আছেন, মেরিনা বেসরার মুখের হাসিতেই তা ফুটে উঠল। তাঁর বড় ছেলে মাথিয়াস মুর্মু বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) হাবিলদার। মেজ ছেলে মানুয়েল মুর্মু ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। আর ছোট ছেলে সামুয়েল মুর্মু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব। সন্তানদের যোগ্য করে গড়ে তোলার স্বীকৃতি হিসেবে গত মার্চে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ‘অদম্য নারী পুরস্কার-২০২৫’-এ শ্রেষ্ঠ সফল জননীর সম্মাননা পেয়েছেন ৬৭ বছর বয়সী এই নারী। এলাকায় সবাই তাঁকে এখন মান্য করে।
অথচ কী কষ্টেই না কেটেছে তাঁর প্রথম দিকের জীবন। নিজেই সেই দিনগুলের কথা বললেন মেরিনা, ‘মানুষের জমিতে কাজ করে দৈনিক পেতাম ২০ থেকে ৩০ টাকা। তিন ছেলেসহ পাঁচজনের সংসার। ওদের বাবা ঘরামির (রাজমিস্ত্রি) কাজ করত। মাঝেমধ্যে বড় ছেলেও ওর বাবার সাথে কাজে যেত। এভাবেই ছেলেদের বড় করেছি।’
দেশ স্বাধীনের দুই বছর পর পার্বতীপুরের মেরিনা বেসরাকে বিয়ে করে ঘরে আনেন বিরামপুরের দেশমা গ্রামের মার্কস মুর্মু। স্বামীর বাড়িতে এসে ভিন্ন এক জীবনের দেখা পান বাবার বাড়িতে আদরে বড় হওয়া কিশোরী মেরিনা। মার্কস মুর্মুর আবাদি কোনো জমি ছিল না। মাথা গোঁজার ঠাঁই বলতে ছিল কেবল একটি কুঁড়েঘর। রাজমিস্ত্রির কাজ করে দিন শেষে স্বামী যা পেতেন, তাতে সংসারে টানাটানি লেগেই থাকত। বাড়তি আয়ের আশায় একসময় গ্রামের অন্য নারীদের সঙ্গে দিনমজুরি শুরু করেন মেরিনা।
এই দম্পতির অভাব আর টানাপোড়েনের সংসারে একে একে জন্ম নেয় তিন ছেলে। নিজেরা কষ্ট করলেও তাঁরা চাইতেন, পড়াশোনা করে যেন তাঁদের কষ্ট ঘোচাতে পারে তিন সন্তান। তাই তাঁদের স্কুলে ভর্তি করে দেন। সন্তানেরাও মা-বাবার কষ্ট বুঝতেন। স্কুলে পড়াশোনা, খেলাধুলা আর ব্যবহার দিয়ে সবার মন জয় করে নেন তাঁরা।
মেরিনা বেসরা বলছিলেন, ধানজুড়ি মিশন থেকে ফাদার স্যামসন মার্ডি আসতেন। ছেলেদের পড়ালেখার আগ্রহ দেখে বড় ছেলেকে মিশন হোস্টেলে থেকে পড়ালেখার সুযোগ করে দেন ফাদার। সেখানে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন মাথিয়াস। পরে স্থানীয় দেশমা দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ফুলবাড়ীর বঙ্গবন্ধু কলেজ (বর্তমান নাম চিন্তামন সরকারি কলেজ) থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর বিডিআরে (বর্তমান বিজিবি) সৈনিক পদে চাকরি পান।
মেরিনা-মার্কস দম্পতির মেজ ছেলে মানুয়েল মুর্মু এসএসসি পাসের পর ঢাকার একটি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ওয়েল্ডিং শিখে একটি ইলেকট্রনিক কোম্পানিতে কাজ নেন। ছোট ছেলে সামুয়েল মুর্মু দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স করেন। ৩৩তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সহকারী সচিব হিসেবে যোগ দেন।
তিন ছেলের কল্যাণে মেরিনা বেসরার অভাব এখন ঘুচেছে। পাকা বাড়ি হয়েছে। কয়েক বিঘা জমি কিনে তাতে ধান আবাদ করছেন। ছেলের বউ আর নাতি-নাতনিদের নিয়ে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে। বিভিন্ন সামাজিক কাজে ও স্থানীয়দের সমস্যা সমাধানে ডাক পড়ে।
স্বামীর কথা উঠতেই ভারী হয়ে আসে মেরিনা বেসরার কণ্ঠ। ২০২৩ সালে মারা গেছেন মার্কস মুর্মু। মেরিনা বেসরা বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, আমার স্বামী ছেলেদের সফলতা দেখে গেছেন। আমি এখন আর একা অনুভব করি না। নাতি–নাতনি নিয়ে ভালো আছি।’