খুলনার বিএল কলেজ যে কারণে আলাদা

৪১ একরের এই কলেজে পড়েন ৩৩ হাজার শিক্ষার্থী
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

খুলনার সরকারি ব্রজলাল কলেজের দ্বিতীয় একাডেমিক ভবনটির সেমিনার কক্ষ তখন কানায় কানায় ঠাসা। আগ্রহ নিয়ে কথা শুনছিলেন উপস্থিত অংশগ্রহণকারীরা। আলোচক নেপালের ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক কমল প্রসাদ ফিউয়াল। টি এস এলিয়টের দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড নিয়ে আলোচনা করছিলেন তিনি। 

দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর শতবর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষে গত ২৪ ও ২৫ সেপ্টেম্বর দুই দিনের আন্তর্জাতিক এই সেমিনারের আয়োজন করেছে কলেজের ইংরেজি বিভাগ। সেমিনারে নেপাল থেকে যোগ দিয়েছেন চারজন শিক্ষক। এর বাইরে সেমিনারে ভারতের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ জন শিক্ষক-গবেষক গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছেন। 

সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নিশাত আনিসা ও প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মিম ইসলাম। আয়োজনটি বেশ প্রাণবন্ত হয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা।

নিশাত বলেন, ‘আলোচনা শেষে আমাদের মধ্য থেকে অনেকে আলোচকদের প্রশ্নও করেছে। কিছুদিন আগে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মের দুই শ বছর উপলক্ষে যে সেমিনার হয়েছিল, সেটাও খুব ভালো লেগেছে।’

এমনিভাবে শিক্ষার্থীদের মনে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে খুলনার উচ্চশিক্ষার বাতিঘর ব্রজলাল কলেজ। বিএল কলেজ নামেই যা বেশি পরিচিত। ৪১ একরের এই কলেজে এখন ৩৩ হাজার শিক্ষার্থী। নিয়মিত এখানে আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন হচ্ছে। কলেজের ছাত্র সংসদ পরিচালনা পর্ষদের সংস্কৃতি বিভাগের ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক শংকর কুমার মল্লিক বলেন, ‘কয়েক বছর আগে আমরা গ্রন্থাগারকেন্দ্রিক সেমিনার শুরু করেছিলাম। তখন প্রতি মাসে এক দিন করে চিত্রশিল্পী, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সাহিত্যিক, বাঙালি মনীষীদের জন্মদিন বা মৃত্যুদিনকে কেন্দ্র করে সেমিনারের আয়োজন করা হতো। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করতেন একজন শিক্ষক। অন্য কয়েকজন আলোচক থাকতেন। এটা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশ উৎসাহ তৈরি করেছিল। এর পর থেকে এখন নিয়মিত নানা বিষয়ে সেমিনার হচ্ছে। কখনো কলেজ কর্তৃপক্ষ, কখনো কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, আবার কখনো কোনো বিভাগের উদ্যোগে এগুলোর আয়োজন করা হচ্ছে।’

শংকর কুমার জানালেন, গত দুই বছরে ভার্চ্যুয়াল প্ল্যাটফর্মে এবং স্কলারদের সরাসরি অংশগ্রহণে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সেমিনার হয়েছে। মুজিব বর্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে ১৬টি বিভাগ ১৬টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করেছে।

শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, পরীক্ষা নেওয়া আর মার্কেটে কর্মী সরবরাহ—একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজ শুধু এই না। আগামী দিনে আর প্রথাগত চাকরি হবে না। আগামী দিনের শিক্ষা হবে ইন্টারডিসিপ্লিনারি। তাই ভালোভাবে তৈরি হতে হবে। শতবর্ষী ১৬টি কলেজ সেন্টার ফর এক্সিলেন্স হয়ে উঠবে—এ রকম একটা লক্ষ্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে। সেটা করতে গেলে সেমিনার, জার্নাল এসব জরুরি। ২০১৯ সালে আমরা যখন আন্তর্জাতিক জার্নালের প্রথম প্রকাশনা করেছি, তখন মাথায় ছিল আমাদের আন্তর্জাতিক সেমিনারে যেতে হবে। সেমিনারের গবেষণাপত্রগুলো আবার জার্নালে প্রকাশ হবে। সেমিনার করলাম আর তাঁদের পেপার প্রকাশ করতে পারলাম না, তখন কিন্তু স্কলাররা সেমিনারে আসতে চাইবেন না। আর এখন বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের স্কলারদের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা কঠিন কিছু নয়। একটার সঙ্গে অন্যটা যুক্ত করেই পরিকল্পনা এগিয়েছে।
শরীফ আতিকুজ্জামান, অধ্যক্ষ, ব্রজলাল কলেজ

আছে জার্নাল, আছে ম্যাগাজিন 

শত বছরের ঐতিহ্য ধারণ করা এই কলেজ ২০১৯ সাল থেকে নিয়মিত বিএল কলেজ জার্নাল প্রকাশ করছে। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায় প্রকাশিত এই জার্নালে ভাষা ও সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, পরিবেশ বিজ্ঞানসহ নানা বিষয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও কলেজের শিক্ষক-গবেষকেরা নিয়মিত লিখছেন। বছরে দুটি করে এখন পর্যন্ত জার্নালের আটটি ভলিউম প্রকাশিত হয়েছে। 

গত মার্চ মাসে বের হয়েছে কলেজ বার্ষিকী বিহঙ্গর শতবর্ষ সংখ্যা। যশোহর খুলনার ইতিহাস বইয়ের লেখক, অধ্যাপক সতীশচন্দ্র মিত্রের সম্পাদনায় ১৯২৩ সালে প্রথম দেবায়তন নামে কলেজ ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছিল। সেই বিবেচনায় গত ১০০ বছরের লেখা থেকে বাছাই করে নির্বাচিত কলেজ ম্যাগাজিন (১৯২৩-২০২৩) প্রকাশিত হয়েছে গত জুন মাসে। 

ছাত্র কমন রুমের সামনের চত্বরে আড্ডা দিচ্ছিলেন রসায়ন বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী। তাঁদের একজন খন্দকার আবদুল্লাহ বলেন, ‘অনেক গুণীজন এই কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন, শিক্ষক ছিলেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা ও সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার চমৎকার পরিবেশ এখানে আছে। সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার জন্য এখানে আছে বিএল কলেজ থিয়েটার, ডিবেটিং ক্লাব, আবৃত্তি সংগঠন ‘বায়ান্ন’ ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠন। কলেজের ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব ও বিজ্ঞান ক্লাবও আমাদের জীবনমুখী শিক্ষায় এগিয়ে নিয়ে সহায়তা করছে।’ 

আরেক শিক্ষার্থী সাবরিনা লিজা যোগ করলেন, ‘বিজ্ঞানের সমসাময়িক ঘটনা, বাঙালি বিজ্ঞানীর জীবনী, বিজ্ঞান ক্লাবের বিভিন্ন কাজ নিয়ে প্রথমবারের মতো বিজ্ঞান বিচিত্রা নামে কলেজ থেকে একটা ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশ হতে যাচ্ছে। আমরা লেখা জমা দিয়েছি। এ ছাড়া বিজ্ঞান ক্লাব কলেজে বড় করে বিজ্ঞান মেলার আয়োজনও করে।’