অস্ত্রোপচারে আলাদা হওয়া সেই তৃষ্ণা–কৃষ্ণার বয়স এখন ১৯, কেমন আছেন দুই বোন

২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার এক হাসপাতালে ৩২ ঘণ্টা ধরে অস্ত্রোপচার করে আলাদা করা হয় জোড়া মাথার বোন তৃষ্ণা ও কৃষ্ণাকে। সেই অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করাসহ বাংলাদেশি দুই শিশুর দায়িত্ব নিয়েছিলেন ময়রা কেলি। দুই বোনের খোঁজ নিতে এই মানবহিতৈষীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন কাউসার খান

অস্ট্রেলীয় মানবহিতৈষী ময়রা কেলি
ছবি: গ্লোবাল গার্ডেনস অব পিস

ই-মেইল আর খুদে বার্তা পাঠিয়ে রেখেছিলাম। কয়েক দিন পর মেলবোর্ন থেকে নিজেই ফোন করলেন ময়রা কেলি। অপর প্রান্তে শান্ত, কোমল কণ্ঠ। কিছুক্ষণ পরই দাতব্য সংস্থার আশ্রয়ে থাকা শিশুদের সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাবেন। তাই বললেন, ‘এখন কথা না বললে পরে সময় মেলানো কঠিন হবে, তাই বের হওয়ার আগেই কল দিলাম।’

বুঝতে পারলাম, তাঁর হাতে সময় কম। প্রাথমিক আলাপ-পরিচয়ের পর তাই সরাসরি জানতে চাইলাম তৃষ্ণা আর কৃষ্ণার কথা। বাংলাদেশি এই দুই বোনের নাম–পরিচয় যাঁদের জানা নেই, তাঁদের বলে রাখি, ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে খুলনায় তৃষ্ণা ও কৃষ্ণার জন্ম। মাথা জোড়া লাগানো থাকায় তাঁদের লালন-পালন করতে পারছিলেন না মা-বাবা। দুই বোনকে তাই প্রথমে খুলনার মাদার তেরেসা হোম ও পরে ঢাকায় মাদার তেরেসা এতিমখানায় নিয়ে আসা হয়। পরে দুজনকে অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে যায় ময়রা কেলির দাতব্য সংস্থা চিলড্রেন ফার্স্ট ফাউন্ডেশন। ২০০৯ সালের নভেম্বরে ৩২ ঘণ্টার দীর্ঘ অস্ত্রোপচারের পর আলাদা করা হয় তৃষ্ণা ও কৃষ্ণাকে।

জোড়া মাথার দুই বোন তৃষ্ণা ও কৃষ্ণা, ২০০৯

তৃষ্ণাকে ট্রিশি আর কৃষ্ণাকে ক্রিসি নামে ডাকেন ময়রা। গত ডিসেম্বরে ১৮ বছর পার করেছেন তাঁরা। তবে বড় হতে হতে দেখা যায়, দুই বোনের মধ্যে কৃষ্ণা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ। কথা বলতে পারেন না। তাই কৃষ্ণার প্রতি আলাদা করে খেয়াল রাখেন ময়রা।

তৃষ্ণা–কৃষ্ণার সঙ্গে সম্পর্ক কেমন? হাসিমুখে ময়রা কেলি বলেন, ‘ট্রিশি (তৃষ্ণা) এখন অনেকটা আমার বন্ধুর মতো হয়ে উঠেছে, মাঝেমধ্যে আমার সঙ্গে তর্কও করে। আর ক্রিসি, ও তো আমার সেই ছোট্ট বাচ্চাটাই রয়ে গেছে। ওর নাম শুনলেই আমার চোখে পানি চলে আসে। ওর প্রতিটি হাসি, প্রতিটি স্পর্শ আমার কাছে আশীর্বাদের মতো।’

দুই মায়ের কাছে তৃষ্ণা ও কৃষ্ণা
ছবি: হেরাল্ড সান

প্রেরণা তেরেসা

ময়রা কেলি তখন স্কুলে পড়েন। বয়স সাত বছর। ক্লাসে একদিন মাদার তেরেসাকে নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। ছোট্ট ময়রার মনে ভীষণ দাগ কাটে এই মহীয়সী নারীর কাজ। তিনিও মাদার তেরেসার মতো হতে চান। বলছিলেন, ‘সেই ছোট্ট বয়সেই বাড়ি ফিরে মাকে বলেছিলাম, বড় হয়ে আমিও একদিন এই মানুষের সঙ্গে কাজ করব।’

ছোটবেলার সেই কথা ময়রা ভোলেননি। কৈশোরজুড়ে মনের মধ্যে লালন করেছেন। ২১ বছর বয়সে স্বপ্ন সত্যি করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। নিজের শখের গাড়িটি বিক্রি করে সেই টাকা নিয়ে উড়াল দিলেন ভারতের কলকাতার উদ্দেশে। ময়রা বলেন, ‘সেখানে আমি সরাসরি মাদার তেরেসার সেবা সংস্থায় টানা দুই বছর কাজ করি। মাদার তেরেসার কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষাই আমাকে পরে তৃষ্ণা-কৃষ্ণার মতো বিশ্বের নানা প্রান্তের অসহায় শিশুদের কাছে টেনে নিয়ে গেছে।’

কলকাতায় দুই বছর কাজ করার পর প্রায় ১৪ বছর তিনি এক দেশ থেকে আরেক দেশে ছুটে বেড়িয়েছেন। বসনিয়া, আলবেনিয়া, ইরাক—যুদ্ধবিধ্বস্ত নানা দেশে গিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। শিশুদের সেবা করেছেন। এ কাজ করতে করতেই বুঝতে পারেন, শিশুদের উন্নত চিকিৎসা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে দেওয়া সম্ভব নয়। তখন অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে গড়ে তোলেন ‘চিলড্রেন ফার্স্ট ফাউন্ডেশন’। বলছিলেন, ‘আমি চেয়েছিলাম, আমার কাজটা যেন আরও গোছানো হয়, আর কোনো শিশু যেন শুধু সুযোগের অভাবে কষ্ট না পায়।’

৬১ বছর বয়সে এসেও এই শিশুদের সেবায় কাজ করে যাচ্ছেন ময়রা।

তৃষ্ণা কলেজে পড়ে

তৃষ্ণা এখন
ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

টেলিফোনে ময়রা কেলির সঙ্গে আলাপের সময় পাশেই ছিলেন তৃষ্ণা ও কৃষ্ণা। নিজের জীবনে গল্প শোনাতে শোনাতে একফাঁকে তৃষ্ণার হাতে ফোনটা দিলেন ময়রা কেলি। তৃষ্ণা কথায় বেশ চটপটে ভাব। কথায় কথায় জানান, এবার টুয়েলভ ক্লাসে পড়ছেন, কিছুদিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখবেন। মায়ের আদরে তাঁদের মানুষ করছেন ময়রা কেলি। তাঁদের জন্মদাতা মা-বাবার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আছে, মিনিট দশেক দূরত্বেই থাকেন তাঁরা (অস্ত্রোপচারের কয়েক বছর পর বাংলাদেশ থেকে তৃষ্ণা-কৃষ্ণাদের মা লাভলী মল্লিক ও বাবা কার্তিকচন্দ্র মল্লিককেও অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে আসেন ময়রা কেলি)। বাংলাদেশি খাবারদাবার খেতে পছন্দ করেন বলে মাঝেমধ্যে সেই বাসায় যান তৃষ্ণা। সেই পরিবারে তাঁর দুই ভাই আছে। বাংলাদেশের স্মৃতি সম্পর্কে বলেন, সাত বছর বয়সে খুলনায় গিয়েছিলেন। তাই তেমন স্মৃতি তাঁর মনে নেই। বাংলা ভাষাও শেখা হয়নি, তবে সময় করে শিখে নেবেন।

কথা শেষে আবার ময়রা কেলির হাতে ফোন দেন তৃষ্ণা।

আরও পড়ুন

কৃষ্ণার জন্য কিডনি

কৃষ্ণার সঙ্গে ময়রা কেলি, ২০২২
ছবি: ময়রা কেলির সৌজন্যে

অনেকক্ষণ চেপে রাখা প্রশ্নটা এবার করেই ফেলি, ‘কৃষ্ণাকে আপনি কিডনি দান করলেন?’

ময়রা কেলি বলেন, ‘যেকোনো মা-ই এটা করতেন। ভালোবাসা মানেই তো কষ্টের মাঝেও ভালোবাসা। আমার ক্রিসি আমার কাছে তা–ই। ওর জীবন আমার কাছে সবকিছুর চেয়ে দামি।’

অস্ত্রোপচারের কয়েক বছর পর কৃষ্ণার দুটি কিডনিই বিকল হয়ে যায়। তাঁর জীবন বাঁচাতে জরুরিভাবে কিডনি প্রতিস্থাপনের দরকার হয়ে পড়ে। কিন্তু কোনো দাতাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ২০২১ সালে কৃষ্ণার অবস্থা যখন ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছিল, তখন নিজেই এগিয়ে এলেন ময়রা কেলি। পরীক্ষায় ময়রা কেলির কিডনি কৃষ্ণার শরীরের সঙ্গে ম্যাচ করে যায়। মেয়েকে দান করলেন নিজের একটি কিডনি। নতুন জীবন পেলেন কৃষ্ণা।

অঙ্গদানের বিষয়টি অনেক দিন গোপন রেখেছিলেন। অঙ্গদানে মানুষকে সচেতন করতে ২০২৫ সালের শুরুতে বিষয়টি প্রথম প্রকাশ্যে আনেন ময়রা।

আলাপের শেষ পর্যায়ে এসে ময়রা কেলি বলেন, ‘ভালোবাসা দিয়েই জীবন বদলে দেওয়া যায়। কেউ যদি আপনার দিকে সাহায্যের আশায় তাকিয়ে থাকে, দয়া করে এগিয়ে যান। আমরা যদি একে অপরকে ভালোবাসি, তাহলে পৃথিবীটা আরও অনেক বেশি সুন্দর হবে।’

আরও পড়ুন