অনুপ্রেরণা পাওয়ার মতো ৫ গল্প
প্রায় সব সফল মানুষের জীবনেই একটা ব্যাপার আপনার চোখে পড়বে। তাঁরা জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে ধাক্কা খেয়েছেন, ভেঙে পড়েছেন, মানুষের কটু কথা শুনেছেন। এসব অভিজ্ঞতাই তাঁকে আরও শক্তি দিয়েছে, দিয়েছে অনুপ্রেরণা। তাঁদের জীবনের এসব গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হতে পারেন আপনিও।
স্টিফেন কিং, মার্কিন লেখক
সঠিক বইটা সঠিক মানুষের হাতে পড়লে, একটা আলোর জন্ম হয়। যে আলো একজন থেকে আরেকজনের হাতে ছড়িয়ে পড়ে। আমার অসম্ভব আনন্দ হয়; যখন কেউ বলে কিংবা চিঠি লিখে জানায়, আমার লেখা তার ভালো লেগেছে, তাকে অনুপ্রাণিত করেছে।
ছোটবেলায় আমাকে অনেক টিটকারি শুনতে হতো। রাস্তার ওপারে একজন কৃষক থাকতেন। তিনি আমার দিকে আঙুল তুলে বলতেন, ‘ওই যে যায় স্টিভি। বোকাটা সব সময় বইয়ের মধ্যে নাক ডুবিয়ে থাকে।’ সম্ভব হলে আজ আমি সেই কৃষকের কাছে যেতাম। ট্রাক্টর থেকে নামিয়ে তাকে বলতাম, ‘দেখো, একদিন আমি বইয়ে নাক ডুবিয়ে থাকতাম। আর এখন একটা বিলাসবহুল মার্সিডিজের আরামদায়ক আসনে ডুবে থাকি!’
রাফায়েল নাদাল, স্প্যানিশ ক্রীড়াবিদ
১৭ বছর বয়সে এমনই এক ব্যথা পেলাম যে বলা হলো আর পেশাদার টেনিস খেলতে পারব না। শুধু যে পায়ের পাতায় সামান্য ফাটল ধরেছিল তা নয়, ধরে বসেছিল একটা অসুখ। যে অসুখের কোনো চিকিৎসা নেই। নিয়ম মেনে চলাই একমাত্র উপায়। অসুখটার নাম মুয়েলার-ওয়েইস সিনড্রোম। ভাবুন তো, কাল সকাল থেকে আপনি আর হাঁটতে পারবেন না, কেমন লাগবে?
দিনের পর দিন বাড়িতে বসে শুধু কেঁদেছি। কিন্তু এটা আমার জন্য একটা বড় শিক্ষাও। ভাগ্য ভালো, দারুণ একজন বাবা পেয়েছিলাম, যিনি সব সময় ছিলেন ইতিবাচক। বলতেন, ‘আমরা একটা সমাধান খুঁজে বের করব। আর যদি না পারি, তাহলে তো টেনিস খেলা ছাড়াও জীবনে আরও অনেক কিছু করার আছে।’
এই সব কিছুই আমার কানে ঢুকত না। অনেক ব্যথা, অস্ত্রোপচার, কান্না, পুনর্বাসনপ্রক্রিয়ার পর আবার খেলায় ফিরি। এর মধ্য দিয়েই আমি আদতে লড়াই করা শিখেছি।
টেনিস এমন এক খেলা, যাতে আপনার মনের ওপর প্রচণ্ড চাপ যাবে। কিন্তু এমন সব আনন্দের মুহূর্তও আসবে, যা আপনি কখনো ভুলতে পারবেন না। বহু জয়ের স্মৃতি আমার মনে উজ্জ্বল হয়ে আছে। এই খেলার নিয়মটাই এমন, নিজের সেরাটা দিয়ে যেতে হয় সব সময়। ঢিল দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সব সময় নিজেকে উন্নত করতে হবে, এটাই হয়ে ওঠে জীবনের ধ্রুবক। এভাবেই আমি আরও ভালো খেলোয়াড় হয়ে উঠেছি।
বব আইগার, ডিজনির সিইও
আমার স্বপ্ন ছিল সংবাদ উপস্থাপক হব। কলেজ শেষ করার পর যখন একটা ছোট টিভি স্টেশনে আবহাওয়ার সংবাদ উপস্থাপনের দায়িত্ব পেলাম, ভেবেছিলাম আমি ঠিক পথেই আছি। তবে কিছুদিনের মধ্যে টের পেলাম, আবহাওয়ার সংবাদ উপস্থাপনের কাজে আমি খুবই খারাপ এবং এ কাজ করে আদতে আমার স্বপ্ন পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। তাই ২৩ বছর বয়সে চাকরি ছেড়ে একেবারে অন্য কিছু করার সিদ্ধান্ত নিলাম। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা কিন্তু বেশ সাহসের ব্যাপার। কয় দিন পর আমি এবিসিতে খুব ছোট একটা চাকরি পেলাম। বলতে পারো খুবই নিচের দিকের পদ—প্রোডাকশন সহকারী। কয় দিন পর বস ডেকে জানিয়ে দিলেন, পদোন্নতি পাওয়ার লোক আমি নই। অতএব আমি যেন সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে অন্য কোনো চাকরি খুঁজে নিই। বস ভুল ছিলেন। পরের চাকরিতেই আমি ঠিক পদোন্নতি পেয়েছি। বাকিটা সবার জানা। এসব বলার অর্থ হলো—ধাক্কা খাওয়া, ‘না’ শোনা, এসব তো জীবনেরই অংশ। প্রত্যেক সফল মানুষই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে সংগ্রাম করেছেন, ব্যর্থ হয়েছেন। স্টিভ জবসকে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত অ্যাপল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। ওয়াল্ট ডিজনিকে বলা হয়েছিল, তাঁর নাকি কল্পনাশক্তির অভাব। ভাবতে পারো? ওয়াল্ট জীবনে বেশ কয়েকবার ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু কখনো আশা হারাননি, সাহস হারাননি। আমরাও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চেষ্টা করেছি। সাহসী গল্প বলা অব্যাহত রেখেছি।
অ্যান ম্যারি, ব্রিটিশ সংগীতশিল্পী
কয়েক বছর আগে লস অ্যাঞ্জেলেসে এক আধ্যাত্মিক গুরুর সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাকে বললেন, ‘যত যা-ই করো, নিজের ভেতরের শিশুকে কখনো হারিয়ে যেতে দিয়ো না।’ শুরুতে এর মানে বুঝিনি। কিন্তু কিছুদিন পর তাঁর কথার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছি। কৈশোর থেকে বড় হওয়ার যুদ্ধকে আমি অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে ফেলেছিলাম। বড় হতে হতে এমনটা সবার সঙ্গেই হয়। তবে আমি সেদিনের পর ঠিক করি, আবার নিজের ভেতরের সেই ছেলেবেলার সত্তাকে খুঁজে বের করব। সেই ছেলেবেলার ‘আমি’-কে ফিরিয়ে আনব। পুরোপুরি ফিরিয়ে আনতে না পারলেও অস্বাস্থ্যকর দিকগুলোকে বাদ দিয়ে আনব। ছোটবেলার মতো দিনভর মিষ্টি জিনিস হয়তো খাব না, কিন্তু আমার কৌতূহল, আমার উচ্ছ্বাস, আমার উদ্যম—সবই হবে ছেলেবেলার মতো। হাওয়াই মিঠাই না খেয়ে, এবার না হয় সবজি, অ্যাভোকাডো, টমেটো, আর কলা খেলাম। কিন্তু পৃথিবীটা আমি আবার সেই ছোটবেলার চোখ দিয়ে দেখা শুরু করেছি। তাই এখন আমি নিজের মনের মতো করে সাজি। আমি আর অদ্ভুত কোনো রঙে চুল রাঙাই না। অনেক বছর পর আবার আমি আমার বাদামিরঙা চুল নিয়ে বেশ সুখে আছি। পছন্দমতো গান তৈরি করছি। মানুষ কেমন শুনতে পছন্দ করবে, সেই চিন্তা করছি না। মনে হচ্ছে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছি। ভাবনাগুলো প্রকাশ করতে আমি আর হীনম্মন্যতায় ভুগছি না। অনেক অনেক বছর পর আমার আর নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে না। আমি অবশেষে শান্তি খুঁজে পেয়েছি।
ডোয়াইন জনসন, হলিউডের অভিনয়শিল্পী
প্রথমবার মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম ১৮ বছর বয়সে, তখন ইউনিভার্সিটি অব মায়ামিতে পড়ি। সবকিছু ভালো চলছিল। এর মধ্যে হঠাৎ ইনজুরিতে পড়লাম, কাঁধের হাড় সরে গেল। ব্যস। মিটিং, অনুশীলন সবকিছু থেকে ছিটকে পড়লাম। একে তো প্রথমবার বাড়ি থেকে দূরে থাকা, তার ওপর ক্লাসেও যেতে পারছিলাম না। বিচ্ছিন্ন বোধ করতে শুরু করি। হতাশা পেয়ে বসে। এরপর আরও অনেকবার এমন হয়েছে। কখনো কারণ ছিল আর্থিক সমস্যা, কখনো বিচ্ছেদ।
কীভাবে এই সমস্যা সামাল দিতে হয়, বুঝতে অনেক সময় লেগে গেছে। বুঝেছি তখন, যখন টের পেয়েছি, ‘কথা বলার’ শক্তি কত প্রবল! তাই এখন ছেলে, মেয়ে, নারী, পুরুষ সবাইকে বলি, তোমার একটা সুপারপাওয়ার আছে। সেটা হলো সমস্যা যা-ই হোক, তুমি অন্যকে বলতে পারো। এই সুপারপাওয়ার কাজে লাগাও। মন খুলে দাও। সব সময় যে মন খারাপের কারণ তোমার জানতেই হবে, তা নয়। এমনও হতে পারে, দিনের পর দিন ঘুম থেকে উঠছ, কিছুই ভালো লাগছে না। প্রথমত, মনে রেখো, তুমি একা নও। পৃথিবীতে আরও বহু মানুষের এমন হয়। কথা বলো।