অন্যের জন্য সাদাছড়ি বানান দৃষ্টিহীন মমতাজ

প্রায় ১০ বছর ধরে সাদাছড়ি তৈরি করছেন মমতাজ
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

দুই চোখ আলোহীন। পথ চলতে মমতাজ ইসলামের নিত্যসঙ্গী সাদাছড়ি। আলোহীন চোখ নিয়েই মমতাজ তাঁর মতো মানুষদের নিরাপদে পথচলাকে সুগম করতে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রায় ১০ বছর ধরে তৈরি করছেন সাদাছড়ি।
মমতাজের বয়স এখন ৩৯। ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল মানুষের কল্যাণে কিছু করা। সেই স্বপ্নের পথ ধরে অনেকটা দূর হেঁটেও ছিলেন তিনি। যশোরের কেশবপুরের মেহেরপুর গ্রামের মেয়ে মমতাজ মাধ্যমিকের পাঠ চুকিয়ে চলে আসেন খুলনা শহরে। খুলনার একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে নার্সিং বিষয়ে ছয় মাসের ডিপ্লোমা করেন। চাকরিও জুটে যায় সেখানে। এরপর ওই হাসপাতালেরই কর্মী রবিউল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় থেকে প্রণয় হয়ে পরিণয়।
২০০১ সালে বিয়ের কিছুদিন পর থেকে চোখের সমস্যা ধরা পড়ে। প্রথম দিকে চেখে জ্বালা-যন্ত্রণা হতো। লাল হয়ে ফুলে যেত। তবে এসবে খুব একটা পাত্তা দেননি তিনি। পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকলে শহরের বেশ কয়েকজন চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞকে কয়েক দফায় চোখ দেখিয়েছেন। ভারতে গিয়েও চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে অবস্থার উন্নতি হয়নি। চিকিৎসার একটা পর্যায়ে জানতে পারেন তাঁর গ্লুকোমা। সময়মতো আর ধৈর্য ধরে চিকিৎসা না নেওয়ায় চোখের অবস্থা খারাপের দিকেই গেছে। ২০০৫ সালের দিকে তাঁর বাঁ চোখ একদম আলোহীন হয়ে যায়। বছর দুয়েক পরে অন্য চোখের আলোও নিভে যায়। গর্ভে তখন তাঁর দ্বিতীয় সন্তান। দ্বিতীয় সন্তানের মুখ দেখার ভাগ্যও মমতাজের হয়নি। তাঁর দুই সন্তানের একজন এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, আরেকজন পড়ছে ক্লাস সিক্সে। করোনার সময় হাসপাতালের চাকরি ছেড়েছেন স্বামী রবিউল ইসলাম। বাড়ির পাশে একটা চায়ের দোকানের আয় আর মমতাজের ছড়ি তৈরি ও হাঁস-মুরগি পালনের টাকায় চলছে সংসার।

এক চোখ নষ্ট হওয়ার পরও একটা উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করেছেন মমতাজ। দুচোখেই যখন আর দেখেন না, তখন বাড়ির বাইরে বের হতে পারছিলেন না। সংসারে অনটন একটু একটু ভর করতে থাকে। মমতাজদের একজন কাছের আত্মীয় প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য আবেদন করার পরামর্শ দেন। এ জন্য সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে প্রত্যয়ন দরকার পড়ত। খালিশপুরের গোয়ালখালী থেকে মূল শহরে যাওয়ার জন্য বাসস্ট্যান্ডে যখন মমতাজ দম্পতি অপেক্ষা করছিলেন, সে সময় মাইন উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের কল্যাণে ‘ন্যাশনাল সোসাইটি অব দ্য ব্লাইন্ড অ্যান্ড পারশিয়ালি সাইটেড (এনএসবিপি)’ নামের একটি সংগঠন পরিচালনা করেন। ওই ব্যক্তি ঠিকানা দিয়ে তাঁর অফিসে যেতে বলেন। পরে ওই সংগঠনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখাপড়া শেখেন মমতাজ। সেখান থেকেই শিখেছেন সাদাছড়ি তৈরি।
মমতাজ বলেন, ‘আমি জন্মান্ধ না। আমার স্বামীর পরিবারে বা আমার নিজের কুলের কেউই দৃষ্টিহীন না। ছোটবেলা থেকে পৃথিবীর রূপ-রং দেখে বড় হয়েছি। যখন প্রথম চোখে দেখা বন্ধ হয়, তখন মনে হতো আমি বোধ হয় একাই দেখতে পাচ্ছি না। চোখের পাশাপাশি আমার মনের দুনিয়াও অন্ধকার হয়ে যায়। এই সংগঠনে যখন এলাম, অনেকের সঙ্গে কথা হলো, পরিচয় হলো। তাঁদের সংগ্রামের কথাটাও শুনলাম। তখন থেকে কষ্ট-দুঃখ আর নেই। এখন আর নিজেকে একা মনে হয় না। সুস্থ মানুষের মতো জীবনযাপন করছি।’

প্রায় ১০ বছর ধরে সাদাছড়ি তৈরি করছেন মমতাজ। হাতের সাদাছড়ির শব্দই বলে দেয় সামনে মেইন রোড, ফুটপাত, পানি, কাদা, গর্ত নাকি ড্রেন আছে। নিজেদের লাঠি নিজেরা তৈরি করছেন, এটা গৌরবের বিষয়। আরেকজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ভাইবোন এটা ব্যবহার করতে পারছেন ভাবলে নিজের কাছে অনেক ভালো লাগে মমতাজের। এ ছাড়া কত মানুষ তো অন্ধ হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করছে। মমতাজরা সম্মানের সঙ্গে কাজ করছেন। মানুষের কল্যাণ হচ্ছে, আবার তাঁদের কর্মসংস্থানও হয়েছে।
খালিশপুরের গোয়ালখালী প্রধান সড়কের ক্লাবের মোড়ের ১৪৫ নম্বর বাড়িতে সাদাছড়ি উৎপাদন কেন্দ্র। বাড়ির বড় একটি অংশে সাদাছড়ি বানানোর জন্য ভারী ভারী মেশিন ও বিভিন্ন সামগ্রী রাখা। বস্তায় বস্তায় ভরে রাখা সাদাছড়ি। ২০১২ সালে ছড়ি তৈরি শুরুর দিকে ওই সংগঠনের ১৮ জন সাদাছড়ি তৈরির কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে মমতাজসহ পাঁচজন দৃষ্টিহীন নারী সাদাছড়ি তৈরির কাজ করছেন। নয়টা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত ছড়ি তৈরি করেন তাঁরা। এই সময়ের মধ্যে ঘণ্টা দুয়েক বিরতি মেলে। আর ছড়ি তৈরি বাবদ মাসে সাড়ে চার হাজার টাকার মতো পেয়ে থাকেন চোখের আলো নিভে যাওয়া এসব নারী।
মমতাজ জানান, ভাঁজ করা এসব ছড়ি তৈরি করার জন্য পাইপ কাটা, সেগুলোর মাথা ঘষে সমান করা, এক খণ্ড পাইপের মধ্যে আরেক খণ্ড ঢোকানোর উপযোগী করা, ভেতরে রাবারের ফিতা পরানোসহ বিভিন্ন ধাপ রয়েছে। একেকজন প্রতিদিন গড়ে ২৫টি সাদাছড়ি তৈরি করতে পারেন।
এনএসবিপির সেবা সমন্বয়কারী কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘আমাদের সংগঠনটি দৃষ্টিহীনদের জন্য দৃষ্টিহীনদের দ্বারা পরিচালিত। মূলত বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, জেলা সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এসব ছড়ির ক্রেতা। আমাদের সংগঠনের উদ্যোগে বিভিন্ন উপলক্ষে বিনা মূল্যে এসব সাদাছড়ি বিতরণ করা হয়। এখানে বছরে ৩০ হাজার সাদাছড়ি উৎপাদন হয়। সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবসকে সামনে রেখে এসব ছড়ির চাহিদা আরও বেড়ে যায়।