কেমন হলো বিড়ালের ফ্যাশন শো

ফ্যাশন শোতে এভাবেই সেজে আসে একটি বিড়ালছবি: সুমন ইউসুফ

পেছনের পা দুটি বিকল। তাই হাঁটতে পারে না দুখু মিয়া। তারপরও ক্যাট র‍্যাম্প শোতে সেরা হাঁটিয়ে হয়েছে রাজধানীর উত্তর বাড্ডার সোহেল সরকারের আদরের বিড়াল দুখু মিয়া। যমুনা ফিউচার পার্কের নবাব হলে গত শুক্রবার আয়োজিত এই আনন্দ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে নিজেদের আদরের বিড়াল নিয়ে আসেন বিড়ালপ্রেমীরা। বিড়াল কোলে নিয়ে র‍্যাম্পে হাঁটার প্রতিযোগিতা ছাড়াও ছিল বিড়ালের যেমন খুশি তেমন সাজো এবং খাদক বিড়াল প্রতিযোগিতা।

অনুষ্ঠানে আরও ছিল খাদক বিড়াল প্রতিযোগিতা
ছবি: সুমন ইউসুফ

অনুষ্ঠানে বাহারি সাজে সজ্জিত নানা বিড়ালের দেখা মিলল। আদরের বিড়ালকে কেউ সাজিয়েছেন জাদুকর, কেউবা বস বেবি। কাউকে পরানো হয়েছে কুশিকাঁটার জামা, কারও গায়ে ছিল হাওয়াই সাজ। কারও কারও চোখে রঙিন চশমাও ছিল। কাউকে পরানো হয়েছে মালা, কারও সাজে ভিন্নমাত্রা এনেছে ‘বো’ কিংবা টুপি। ঢাকার উত্তরার গৃহিণী শৈলরানী সরকার তাঁর বিড়াল শাকম্বরীকে রাজকন্যা সাজিয়ে এনেছিলেন। ব্রাইডাল সাজের বিড়ালেরও দেখা মিলল। কে আর্জেন্টিনা আর কে ব্রাজিল সমর্থক, বিড়ালের পোশাক দেখে সেটিও বোঝা গেল। মৌমাছি আর গুবরেপোকার থিমেও সাজ ছিল। ভ্যাম্পায়ার আর রবিন হুডের সাজে নিজেদের বিড়ালদের সাজিয়ে এনেছিল স্কুলপড়ুয়া দুই বন্ধু।

নিজের পোষ্যকে নিয়ে রানওয়েতে সেলফি তুলতেও দেখা গেল অনেককে
ছবি: সুমন ইউসুফ

খুলনা ক্যান্টনমেন্ট কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মৌসুমী সুলতানা নিজের বিড়ালটিকে শাহরুখ খানের মতো পোশাক, রুমাল আর সানগ্লাসে সাজিয়ে এনেছিলেন। জানালেন, কন্যার ইচ্ছায় বিড়ালটিকে বাসায় এনেছিলেন তিনি। কন্যার শর্ত ছিল, বিড়ালটিকে যদি বাড়ির সন্তান হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব হয়, কেবল তাহলেই যেন আনা হয়। সেই শর্ত মেনেই ইচ্ছাপূরণ করেছেন এই মা। বিড়ালটি এখন তাঁর বাসায় ‘মহারাজা’ হয়েই থাকছে।

যত্নে রাখার মানসিকতা জরুরি

একটা বাড়িতে বিড়াল আনা হলে সময়মতো তাকে খেতে দিতে হয়, প্রস্রাব-পায়খানার ব্যবস্থা করতে হয় ঠিকঠাক। আদর দিতে হয়, এমনকি দিনের কিছুটা সময়ও তার জন্য বরাদ্দ রাখতে হয়। নিয়মিত টিকা দেওয়া এবং কৃমির ওষুধ সেবন করানোও জরুরি। অসুস্থ হলে চিকিৎসাও করাতে হয়। এ তো আর খেলনা নয় যে খেলা শেষে কোথাও উঠিয়ে রাখলেই হলো। এ হলো রক্ত-মাংসের শরীর। বিড়ালের বুদ্ধিমত্তাও নেহাত মন্দ নয়। ওদেরও কিছু পছন্দ-অপছন্দ থাকে। এমন মানবিক দিকগুলো উঠে এল অনুষ্ঠানের বিচারক নায়লা নাঈমের কথায়। অসহায় পথপ্রাণীদের সাধ্যমতো খাবার দেওয়ার মানবিক আবেদনও জানালেন খ্যাতিমান এই মডেল। বিচারক হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন সংগীতশিল্পী মেহরীন।

এই বিড়ালটি এসেছিল চোখে রঙিন চশমা পরে
ছবি: সুমন ইউসুফ

অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকা ফুটবলার কায়সার হামিদ বলছিলেন স্রষ্টা এবং তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসার কথা। প্রাণীর প্রতি সহিংসতা বন্ধের অনুরোধ জানালেন আরেক বিচারক আফজাল খান, যিনি ‘রবিনহুড’ হিসেবে পরিচিত। কেবল বিড়াল কিংবা কুকুরই নয়, ভারবাহী ঘোড়া কিংবা পথশ্রমে ক্লান্ত গরুর ওপর অত্যাচার বন্ধের বিষয়টিও উঠে আসে তাঁর প্রতিষ্ঠান রবিনহুড দ্য অ্যানিমেল রেসকিউয়ারের ভিডিও চিত্রে। বার্তা ছিল এটাই, মানুষ হিসেবে সব প্রাণীর প্রতি মানবিক আচরণ করা আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব।

অসহায় প্রাণের পাশে

কেবল পার্সিয়ান বা মিশ্র জাতের বিড়ালই নয়, যত্ন করলে দেশি বিড়ালকেও সুন্দর দেখায়। তাই বিড়াল কেনার চেয়ে রাস্তার অসহায় বিড়ালকে আশ্রয় দেওয়াকেই উৎসাহিত করলেন বিচারকেরা।

বাহারি সাজে একটি বিড়াল এভাবেই মঞ্চে আসে
ছবি: দিপু মালাকার

যে দুখু মিয়ার কথা বলছিলাম শুরুতে, সাত মাস আগে রাস্তা থেকেই তাকে উদ্ধার করা হয়েছিল মারাত্মক আহত অবস্থায়। সোহেল সরকারের যত্নে চেহারা ফিরেছে তার। হাঁটার শক্তিটা অবশ্য ফেরানো যায়নি। প্রস্রাব-পায়খানা করার জন্যও মানুষের সহায়তার প্রয়োজন হয় তার। সোহেল কিন্তু বিরক্ত হন না। হাসিমুখে দুখু মিয়ার সেবা করেন। এমন মানুষই তো সত্যিকার ‘মানুষ’।

বিড়ালটিকে আর্জেন্টিনার জার্সি পরিয়ে আনা হয়
ছবি: দিপু মালাকার

অনুষ্ঠানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন বিড়ালপ্রেমীরা। তবে বিচারকেরা এটাও বলছিলেন, সব সাজ বা সব কাজ বিড়ালের জন্য ঠিক নয়। প্রতিটি প্রাণীর নিজস্ব স্বাধীনতা রয়েছে। কোনো কোনো সাজপোশাক বহন করাটাও অনেক প্রাণীর জন্য অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। উচ্চমাত্রার শব্দে, অচেনা বিড়াল আর মানুষের ভিড়ে ভয়ও পেয়ে যায় ওরা। প্রাণীদের জোর করে কোনো কিছু করতে বাধ্য করাটা অমানবিক। তাই যেকোনো পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে আগ্রহী নয়, এমন বিড়াল যাঁদের রয়েছে, তাঁদের এ ধরনের কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে হবে চিন্তাভাবনা করে। নিজের বিড়ালের মনটাকে বুঝতে হবে। এটি একটি আবশ্যিক দায়িত্ব।

অনেক মানুষের মধ্যে এসে কোন কোন বিড়াল ঘাবড়েও যায়
ছবি: প্রথম আলো

অনুষ্ঠানের শেষ দিকে একেকটি বিড়ালকে নিজে নিজে হাঁটার জন্য র‌্যাম্পে ছেড়ে দেওয়া হয়, যেখানে উৎসাহী মানুষের ভিড়ে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে অধিকাংশ বিড়াল। তারপরও র‌্যাম্পে বিড়ালকে হাঁটাতে এবং সেই হাঁটা দেখতে মানুষের তুমুল উৎসাহ, যা বিড়ালের মতো কোমল স্বভাবের প্রাণীর জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নামটা ‘ক্যাটওয়াক’ হলেও র‌্যাম্পে আসলে মানুষকেই মানায়। পুরস্কারের মঞ্চের ভিড়েও ভীতসন্ত্রস্ত হয়েছে বিজয়ী বিড়ালগুলো।