সৈয়দ আব্দুল হাদী—বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গান যাঁর গায়কিতে পেয়েছে নতুন মাত্রা

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গান যাঁদের গায়কিতে নতুন মাত্রা পেয়েছে, সৈয়দ আব্দুল হাদী তাঁদের অগ্রগণ্য। গুণী এই সংগীতশিল্পী আজ শুক্রবার পেলেন মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা ২০২৩। তাঁর গায়ক হয়ে ওঠার গল্প শোনাচ্ছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ

সৈয়দ আব্দুল হাদীছবি: কবির হোসেন

সময়: ১৯৫৫ সাল, স্থান: ব্রাহ্মণবাড়িয়া

বাদ্যযন্ত্রের দোকান। দোকানের ইতিউতি ছড়ানো–ছিটানো সেতার, সরোদ, বেহালা, হারমোনিয়াম। ঝাঁকড়া চুলের এক কিশোর সেতার বাজাচ্ছে। মা–বাবা তাকে ডাকে শাজাহান নামে। ওই কিশোরের পেছনেই দাঁড়িয়ে আছেন ওস্তাদ ইসরাইল খান। তিনি সংগীতশিক্ষক। পাশাপাশি বাদ্যযন্ত্রের এই দোকানও চালান। একমনে সেতার বাজাচ্ছে কিশোরটি। সেতারের তারের ঘর্ষণে ক্ষত–বিক্ষত হয়ে গেছে তার হাত। তার তখন মনে পড়ছে, পয়লা দিনেই নবম শ্রেণিপড়ুয়া তাকে সেতারের প্রাথমিক পাঠ দিয়ে ইসরাইল খান বলেছিলেন, ‘এবার প্র্যাকটিস করো।’

সেই ‘প্র্যাকটিস’ থেকেই যত সমস্যা! আঙুলে ফোসকা পড়ে রক্তারক্তি হয়ে নাকাল অবস্থা।

আগে এই কিশোর আপন খেয়ালে গান গাইত। শহরের সিনেমা হলে গিয়ে একেকটি হিন্দি সিনেমা দেখত। তারপর গলায় তুলে নিত ওই সিনেমার গান। উড়ান খাটোলা সিনেমা দেখে এসে যখন মোহাম্মদ রফির বিখ্যাত গান, ‘ও দূর কে মুসাফির, হাম কো ভি সাথ লে লে’ গাইল, বন্ধুমহলে ধন্য ধন্য রব উঠল। এই যখন অবস্থা, তখন কেন সেতার শিখতে এসেছিল সে!

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সৈয়দ আব্দুল হাদী
ছবি: কবির হোসেন

রক্তমাথা আঙুলে সেতার ‘প্র্যাকটিস’ করতে করতে সিনেমার দৃশ্যের মতো এসব ছবি ভেসে উঠছে ছেলেটির মনে। হাতের আঙুলে প্রচণ্ড ব্যথার কারণে দুচোখ দিয়ে দরদর করে জল ঝরছে। আর ওই ব্যথা ভুলে থাকার জন্যই সেতারের তালিম নিতে নিতে সে গুনগুনিয়ে গাইছে, ‘তু গঙ্গা কি মৌজ ম্যায় যমুনা কা ধারা…’

এ সময় কখন যে পেছনে ইসরাইল খান এসে দাঁড়িয়ে তার গান শুনছেন, সে তা খেয়াল করেনি। সেতার বাজাতে বাজাতে ছেলেটি গান করছে দেখে ওস্তাদ তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘সেতার বাজানো তোমার কাজ নয়, তুমি বরং গানই গাও বাবা।’

এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সেই সেতার না শিখতে পারা ছেলে বিখ্যাত হয়েছেন গান গেয়েই। চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, তিনি গাইতে গাইতে গায়েন, সংগীতে এই মানুষ কখনো প্রথাগত কোনো শিক্ষা নেননি; বরং নিজের চেষ্টায় সংগীতে হয়েছেন স্বশিক্ষিত।

স্ত্রী ফখরুন্নাহার ও সৈয়দ আব্দুল হাদী
ছবি: কবির হোসেন

সময়: ২০২৩ সাল, স্থান: ঢাকা

৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় আমরা যখন তাঁর ধানমন্ডির বাসায় পৌঁছলাম, ঘরে তখন কেউ নেই, কেবল বড় একটা ছবির ফ্রেমে ছড়িয়ে আছে তাঁর হাসিমুখ। আর ওই ছবির নিচে ইংরেজিতে বড় বড় হরফে লেখা, ‘দ্য লিজেন্ড: সৈয়দ আব্দুল হাদী’।

আমাদের সংগীতাঙ্গনের বয়োজ্যেষ্ঠ সংগীতশিল্পীদের একজন সৈয়দ আব্দুল হাদী, ‘লিজেন্ড’ তো তিনি বটেই। বসার ঘরের চারধারে ছড়িয়ে রয়েছে তার নমুনা—পাঁচটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের বাঁধানো সনদপত্র ও ছবি, একুশে পদকের সনদপত্র, বিভিন্ন সম্মাননাপত্র ছাড়া ঘরে রয়েছে নানান বইও।

অতঃপর ‘লিজেন্ড’ সৈয়দ আব্দুল হাদী মুখোমুখি হলেন আমাদের। কিন্তু কোথা থেকে গল্প শুরু করব? প্রথমা প্রকাশন থেকে জীবনের গান নামে সৈয়দ আব্দুল হাদীর যে আত্মজীবনী বেরিয়েছে, সেখানে নিজের সংগীতজীবনের নানা ঘটনা এত বিশদভাবে তিনি লিখেছেন যে আলাপ শুরু করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে! আমরা কি ১৯৪০ সালের ১ জুলাই জন্ম নেওয়া এই শিল্পীর একদম ছোটবেলার গল্প দিয়ে শুরু করব, যেখানে আগরতলায় গাজী মিয়া নামে এক বংশীবাদকের বাঁশির সুর শুনে কিছু না বুঝেই মোহিত হতেন তিনি? নাকি বলব তাঁর বাবা সরকারি কর্মকর্তা সৈয়দ আব্দুল হাইয়ের সেই কলের গানের কথা? এই কলের গানে বিভিন্ন শিল্পীর গান তাঁকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো টানত। তাঁর বাবাও ছিলেন শখের গাইয়ে।

‘কিন্তু আব্বা চাননি, তাঁর সন্তানেরা কেউ শিল্পী হোক। সে জন্য তিনি আমাদের সামনে কখনোই গান গাইতেন না, একা একা নিজের ঘরে গাইতেন,’ কথা শুরু করলেন সৈয়দ আব্দুল হাদী নিজেই।

—আপনি তাহলে শিল্পী হলেন কীভাবে?

—ওই যে গাইতে গাইতে…। আসলে আমি তো শিল্পী হতে চাইনি। কিন্তু কপালের ফের… ভবিতব্য…গানটা বোধ হয় আমার রক্তের মধ্যেই ছিল।

১৯৭৮ সালে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তিতে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বাঁ থেকে—সৈয়দ আব্দুল হাদী, ওস্তাদ কাদের জামেরি, আব্দুল আহাদ, আব্দুল হালিম চৌধুরী, সাবিনা ইয়াসমীন ও আনোয়ার উদ্দীন খান
ছবি: কবির হোসেন

শুঁয়াপোকা থেকে প্রজাপতি

সাত ভাইবোনের মধ্যে সৈয়দ আব্দুল হাদী সবার বড়। মা–বাবা চেয়েছিলেন, বড় ছেলে হবে সরকারি কর্মকর্তা। তবে ছেলের স্বভাব যে খানিকটা বাউন্ডুলে ধরনের! পড়াশোনার চেয়ে গানের দিকেই পড়ে থাকে তাঁর মন। তাই স্কুল পালিয়ে ছুটে যান সিনেমা হলে। সিনেমার গানগুলো কণ্ঠস্থ করার জন্য একাধিকবার দেখেন একেকটি সিনেমা। তা বলে পড়াশোনায় লাড্ডুগুড্ডু ছিলেন না মোটেই, ১৯৫৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্নদা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৫৮ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।

বাংলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার পরই শিল্পী হিসেবে ‘শুঁয়াপোকা থেকে প্রজাপতি’ হওয়ার শুরু তাঁর। বিভাগের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে প্রথম একক গান হিসেবে গাইলেন ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’। এই রবীন্দ্রসংগীতের পাশাপাশি একই অনুষ্ঠানে আরেক সহপাঠীর সঙ্গে গেয়েছিলেন ‘ময়ূরকণ্ঠী রাতের নীলে’। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয়ভাবে যে নবীণবরণ অনুষ্ঠান করে, সেখানেও শিল্পী হিসেবে ডাক পড়ে তাঁর। ওই দিনের স্মৃতি মনে করে বলেন, ‘সেদিন যখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের “মৌবনে আজ মৌ জমেছে বউ কথা কও ডাকে” গানটি যখন গাইছিলাম, পা দুটো কাঁপতে শুরু করেছিল ভয়ে। পরে তো নানা অনুষ্ঠানে গান করেছি।’

কথা বলতে বলতে বাবরার স্মৃতির খেরোখাতা মেলে ধরছিলেন এই শিল্পী, ‘আমার শিল্পী হওয়ার পেছনে আসলে ছিল আমার বন্ধুদের উৎসাহ। কলেজজীবন থেকে আমার বন্ধু ছিল অভিনেতা নাজমুল হুদা বাচ্চু। সে বারবার আমাকে ঠেলেঠুলে স্টেজে পাঠিয়েছে। এমনকি যেদিন আমি প্রথম সিনেমার গানে কণ্ঠ দিই, সেদিনও আমার সঙ্গে ছিল বাচ্চু।’

হঠাৎ সিনেমার প্লেব্যাকে

সৈয়দ আব্দুল হাদীর সিনেমার গানে কণ্ঠ দেওয়াও খুব কাকতালীয়। ১৯৬০ সাল। তিনি থাকতেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। এ সময় বিখ্যাত শিল্পী তালাত মাহমুদ ঢাকায় এলেন। এক অনুষ্ঠানে তাঁকে নিয়ে আসা হলো সলিমুল্লাহ হলে। সেখানে অনেকের সঙ্গে আরও উপস্থিত ছিলেন সে সময়ের খ্যাতিমান উর্দু সংগীত পরিচালক করীম শাহাবুদ্দীন। আব্দুল হাদী ওই অনুষ্ঠানে একটি গান গেয়েছিলেন। আর এতেই তিনি চোখে পড়ে গেলেন যশস্বী সংগীতজ্ঞের। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে তাঁকে যেতে হলো সোজা এফডিসিতে। ওই বছরই ইয়েভি এক কাহানি নামের উর্দু ছবিতে ‘কোয়ি তো সুখকা হ্যায় পেয়ারা, কোয়ি পায়ে না সাহারা’ গান গাওয়ার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে শুরু হলো তাঁর প্লেব্যাক ক্যারিয়ার।

‘প্রথম ছবিতে গান গেয়েই ৩০০ টাকা পেয়েছিলাম। তবে আমি কখনো টাকার জন্য গান করিনি। গান গেয়েছি আত্মার শান্তির জন্য। ১৯৬৫ সালে ডাকবাবু ছবির মধ্য দিয়ে বাংলা গানে প্লেব্যাক শুরু করি। তত দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছি আমি। মাথায় বনবনিয়ে ঘুরছে গানের পোকা।’

মাথায় গানের পোকা

‘গানের পোকা’কে সঙ্গী করেই সৈয়দ আব্দুল হাদী কাটিয়ে দিলেন বাদবাকি জীবন। চাকরিজীবন শুরু করেছিলেন তখনকার জগন্নাথ কলেজে। তবে গানের জন্যই ছাড়লেন শিক্ষকতার চাকরি। পরে প্রযোজক হিসেবে কিছুদিন কাজ করেছেন বাংলাদেশ টেলিভিশনে। গান গাওয়ার অসুবিধা হচ্ছিল বিধায় ছাড়লেন সেটাও। শেষমেশ চাকরিজীবনে থিতু হয়েছিলেন পাবলিক লাইব্রেরিতে। সেখান থেকেই অবসরে গেছেন ১৯৯৮ সালে। তবে গান থেকে অবসর?

‘কভু নয়। ২০২১ সাল পর্যন্ত আমি সিনেমায় গান করেছি। পরে তো আমার করোনা হলো। নানা রকম শারীরিক সমস্যা দেখা দিল। এখন আর আনুষ্ঠানিকভাবে গান করা হয় না। তবে বিভিন্নজনের গান শুনি।’

কথায় কথায় গড়াল অনেক কথা। জানা গেল, সৈয়দ আব্দুল হাদীর গানে মুগ্ধ হয়ে সেই ১৯৬৬ সালে এ শিল্পীর ঘরনি হয়ে এসেছিলেন ফখরুন্নাহার ঊষা নামের যে তরুণী, ২০০৯ সালে তাঁকে একা করে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন তিনি। আর তখন থেকেই সৈয়দ আব্দুল হাদীর একাকী জীবনে গানই যেন তাঁর একমাত্র সঙ্গী।

সব কথার শেষে রাত যখন গাঢ় হয়ে এসেছে, তখন তিন মেয়ের পিতা এই ‘লিজেন্ড’ শিল্পী আবার ফিরলেন গানের কাছেই। বললেন, ‘অনেক বঞ্চিত হলেও এ জীবন নিয়ে আমার কোনো খেদ নেই। জীবনভর শুধু গান করে গেছি, শেষেও তাই গানের মধ্য দিয়েই বিদায় বলা যাক।’

আমরা দেখলাম, দরাজ গলায় সৈয়দ আব্দুল হাদী গাইছেন:

‘আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ,

তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান,

বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান॥’