অঙ্কুরেই ঝরে গেল যেসব ফুল
কোনো ছবিতে হাসি হাসি মুখ, মায়াবী চাহনি; কোনোটায় শৈশবের দুরন্তপনা। মায়াকাড়া এসব মুখের গুণেই সাদাকালো ছবিগুলোও হয়ে উঠেছে বর্ণিল। এগুলো সবই ‘অঙ্কুর’ শিরোনামে এক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর ছবি। আলোকচিত্রী ফারহানা সেতু। রাজধানীর বনানীতে এশিয়াটিক সেন্টারে ‘বাতিঘর-স্মৃতিতে স্মরণে আলী যাকের’ জাদুঘরের গ্যালারিতে চলছে এ প্রদর্শনী। মঙ্গলদীপ ফাউন্ডেশন এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে।
এসব ছবির নেপথ্য–গল্প শুনে বিষাদে ভরে যায় মন। ‘অঙ্কুর’ নামের এ প্রদর্শনীর শিশু-অঙ্কুরগুলোর বেশির ভাগই আর কোনো দিন কলির রূপ পাবে না, ফুল হয়ে ফুটবে না। ছবির এই শিশুদের প্রত্যেকে লিউকেমিয়া, অর্থাৎ একধরনের রক্ত ক্যানসারে আক্রান্ত, যার পোশাকি নাম অ্যাকিউট লিমফোসাইটিক লিউকেমিয়া (এএলএল)। ২১টি আলোকচিত্রে ২১ শিশুর মুখ জায়গা পেয়েছে। ফারহানা সেতু বলেন, ‘এই ২১ জনের ১৯ জনই আর নেই।’
ফারহানা সেতু বলে যান, ‘শিশুদের এ ধরনের ক্যানসার ৯৩ থেকে ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রেই নিরাময়যোগ্য। মূলত, অর্থনৈতিক কারণেই আমাদের দেশে এ রোগে আক্রান্ত বেশির ভাগ শিশু মারা যায়। শিশুর পরিবার চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে পারে না। সেটা করা গেলে আক্রান্ত শিশুরা আজ বেঁচে থাকত।’
লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের ছবি তোলার ভাবনা কীভাবে এল? সেতু বলেন, ‘২০১৬ সালে ৫ বছর বয়সী আমার এক খালাতো বোন এ রোগে আক্রান্ত হয়। তার চিকিৎসার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) আমি ওর সঙ্গে থাকতাম। তখন এমন অনেক রোগীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়।’ ফারহানা খেয়াল করে দেখলেন, বেশির ভাগ শিশুর চিকিৎসা শুরুর পর সেটা আর চালিয়ে যেতে পারে না তার পরিবার। অনেকে তো চিকিৎসাই শুরু করতে পারে না। বাড়ি নিয়ে গিয়ে ঝাড়ফুঁকের অপচিকিৎসা চালাতে থাকে।
চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল বলে ফারহানার সেই বোন এখন সুস্থ। মানে এটি নিরাময়যোগ্য। কিন্তু শুধু অর্থের অভাবে অকালেই ঝরে যাচ্ছে অনেক শিশু। এসব দেখে ফারহানা সেতুর মনে হয়, তাঁর যে কাজের মাধ্যম, অর্থাৎ আলোকচিত্র, তা–ই দিয়ে এই শিশুদের কথা তুলে ধরবেন। ‘খালাতো বোন সুস্থ হওয়ার পর আমার মনে হলো, এটা নিয়ে কথা বলা দরকার, সচেতনতা তৈরি করা উচিত। শুরু করলাম আমার কাজ।’
২০১৬ সাল থেকে এদের ছবি তোলা শুরু করলেন ফারহানা। হাসপাতালে যে শিশু চিকিৎসা নিতে আসছে, খেয়াল করে দেখলেন, পরের মাসেই সে আসছে না। ঠিকানা নিয়ে তাদের বাড়ি চলে যেতেন ফারহানা। ছোট ছেলেমেয়েরা ছবি তুলতে চাইত না। সহজ হতে পারত না। ফারহানা তখন তাদের বলতেন, ‘যদি তোমাকে একটা জাদু দিই, তবে কী করতে চাও।’ এক শিশু বলেছিল, সুপারম্যান হয়ে সে শিশুপার্কে যেতে চায়। ফারহানা তাকে সুপারম্যানের পোশাক দেন, সেটা পরিয়ে ছবি তোলেন। শিশুরা মনের আনন্দে মেতে ওঠে। ‘এমনিতেই ওরা জীবনের সীমারেখায় চলে এসেছে, তাদের বেদনামাখা ছবি তাই তুলতে চাইনি। ওরাও যে কল্পনা করে, স্বপ্ন দেখে, তাই একটু নাটকীয়তা দিয়ে ছবিগুলোয় তুলে এনেছি,’ ছবিগুলোর নেপথ্যের দর্শন ব্যাখ্যা করছিলেন সেতু। বিভিন্ন হাসপাতাল, প্যালিয়াটিভ কেয়ার সেন্টার, আক্রান্ত শিশুদের বাড়ি—সারা দেশ ঘুরেই ছবি তুলেছেন ফারহানা। এ পর্যন্ত লিউকেমিয়া আক্রান্ত শতাধিক শিশুর ছবি তুলেছেন তিনি।
১০ বছর বয়সী নয়নের সঙ্গে বিএসএমএমইউতে ফারহানার দেখা হয়েছিল। মাত্রই ধরা পড়েছে ওর রোগ। কিন্তু সে হাসপাতালে থাকল না। কুষ্টিয়ায় নয়নের বাড়ি গেলেন ফারহানা। সেখানে কবিরাজি চিকিৎসা চলছে। কান্নাকাটি করলেন তার মা-বাবা। কিছুই তাঁদের করার নেই। সাত থেকে আট মাস আগে বিএসএমএমইউর প্যালিয়াটিভ কেয়ারে শেষ দেখা। তখন নয়নের দিন ফুরানোর পালা। আরেক শিশুর কথা শোনান ফারহানা। ‘ফাতেমা স্কুলে যেতে চাইত। বন্ধুদের সঙ্গে আবার মেতে উঠতে চাইত।’ এমন অনেক গল্প আছে ফারহানার কাছে।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনশাস্ত্রে স্নাতক করে ছয় মাস এক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষানবিশি করেন ফারহানা। একসময় বুঝতে পারলেন, আইন পেশার চেয়ে ছবি তোলায় তাঁর আনন্দ বেশি। এ আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই। পাঠশালা—সাউথ এশিয়া মিডিয়া ইনস্টিটিউট থেকে প্রথমে বেসিক, পরে তিন বছরের পেশাদার কোর্স করেন। ড্যানিশ স্কুল অব মিডিয়া অ্যান্ড জার্নালিজম থেকেও ডিপ্লোমা করেছেন। দেশি-বিদেশি অনেক উৎসব, প্রদর্শনী ও কর্মশালায় অংশ নিয়েছেন। পেয়েছেন বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? ‘ছবিই তুলে যেতে চাই,’ ফারহানার সহজ ও দৃঢ় জবাব। যেমন দৃঢ় আর বাঙ্ময় তাঁর ছবিগুলো।
রাজধানীর বনানীতে এশিয়াটিক টাওয়ারে বাতিঘরে আগামী ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে ‘অঙ্কুর’।