গলা থেকে বের করে আনলাম আস্ত একটা কই মাছ

বাড়িতেই একটা বালতিতে জিইয়ে রাখা ছিল কয়েকটা কই মাছ। তারই একটা সবার অগোচরে মুখে পুরে দিয়েছিল এক শিশু। তারপর প্রাণ যায় যায় অবস্থা। নোয়াখালীর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরেও যখন সমস্যার কোনো কূলকিনারা করা যাচ্ছিল না, তখন পরিবারের লোকজন শিশুটিকে নিয়ে আসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। অস্ত্রোপচার করে মাছটি বের করে আনেন নাক, কান, গলা ও হেড, নেক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক রজতকান্তি সরকার। তাঁর কাছ থেকে সেই রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তের গল্প শুনে অনুলিখন করেছেন রাফিয়া আলম

কই মাছ
আঁকা: সংগৃহীত

গত বছরের শেষ দিকের কথা। জরুরি বিভাগে ডিউটি করছি। রাত ৯টা-১০টা হবে। অ্যাম্বুলেন্স থেকে এক শিশুকে নামানো হলো। বছরখানেক বয়সী শিশুটার শরীর নীলাভ হয়ে গেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে চটজলদি রোগীর ইতিহাস জেনে নেওয়াটাই কর্তব্য। রোগীর সঙ্গে আসা স্বজনেরা জানালেন, একটা আস্ত কই মাছ ঢুকে গেছে শিশুটির গলায়। বোঝাই যাচ্ছিল, মাছটি শ্বাসনালির কোনো অংশে আটকে যাওয়ার কারণে শিশুটির প্রাণসংশয়।

এমন দুর্ঘটনার কথা শুধু শুনেছি, কিন্তু নিজে কখনো দেখিনি। খুব বেশি চিন্তাভাবনারও সময় নেই। প্রতিটি সেকেন্ড তখন অমূল্য। শ্বাসনালিই যখন আটকে থাকে, তখন বাইরে থেকে অক্সিজেন দিয়েও লাভ হয় না। বদ্ধ শ্বাসনালি পেরিয়ে ফুসফুস পর্যন্ত অক্সিজেন পৌঁছাতেই পারে না। এসব ক্ষেত্রে শিশুটিকে বাঁচানোর একটাই উপায়, যত দ্রুত সম্ভব, মাছটাকে বের করে আনা। ঝটপট তাকে অস্ত্রোপচার কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো।

আরও পড়ুন

মুখটা হাঁ করাতেই দেখতে পেলাম, আস্ত একটা কই মাছ। শ্বাসনালি আর খাদ্যনালির সংযোগস্থলে আটকে আছে। মাছটাকে সাবধানে বের করে আনতে হবে। তাড়াহুড়া করতে গেলে মাছটি শিশুটির শ্বাসনালির আরও গভীরে চলে যেতে পারে, এমনকি ফুসফুসেও ঢুকে পড়তে পারে। তাতে জটিলতা আরও বাড়বে। তা ছাড়া টান লেগে শিশুটির গলার ভেতর ক্ষতের সৃষ্টি হতে পারে, যা পরে মারাত্মক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই ভুলও করা যাবে না, আবার তাড়াতাড়িও করতে হবে। স্রষ্টার নাম নিয়ে কাজ শুরু করে দিলাম। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সাহায্যে অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে আস্ত মাছটি বের করে আনলাম। যতটা ভড়কে গিয়েছিলাম, কাজটা ততটা জটিল হলো না। শিশুটির গলায় কোনো আঘাতও লাগল না।

শিশুটিকে অক্সিজেন দেওয়া হলো। অন্যান্য কিছু জরুরি ওষুধও প্রয়োগ করা হলো। ধীরে ধীরে শিশুটির শরীরের নীলাভ ভাব কমে আসতে শুরু করে। আনন্দে ভরে ওঠে আমার মন। জটিল পরিস্থিতিটা সুন্দরভাবে সামলে নিয়েছে জরুরি অস্ত্রোপচারে নিয়োজিত আমাদের কর্মিদল। শিশুটি জীবন ফিরে পেয়েছে।

পর্যবেক্ষণের জন্য রোগীকে অল্প কিছুদিনের জন্য ভর্তি রাখা হয়েছিল। ছোট শিশুটির জীবনের ওপর দিয়ে যে মারাত্মক ঝড় বয়ে গিয়েছিল, প্রাণে বেঁচে যাওয়ার পরও সে ঝড়ের অন্য কোনো প্রভাব রয়ে যাচ্ছে কি না, সেটি নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন ছিল।

আরও পড়ুন

কীভাবে শিশুটির গলায় কই মাছটা আটকাল? শুনেছি, নোয়াখালী বা পার্শ্ববর্তী কোনো এলাকা থেকে ঢাকায় শিশুটিকে নিয়ে আসা হয়েছিল। সন্ধ্যাবেলায় শিশুটির মা ও দাদি যখন নামাজ পড়ছিলেন, তখন শিশুটি নিজে নিজেই খেলছিল। বাড়িতে বালতিতে জিইয়ে রাখা ছিল কয়েকটা কই মাছ। খেলতে খেলতে তারই একটা মুখে পুরে দেয় সে। সেটা গলায় ঢুকে পড়তেই এই বিপত্তি। গলার ভেতর মাছ আটকে থাকায় কাঁদতেও পারছিল না শিশুটি, শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল তার। বিষয়টি বুঝতে পেরেই সঙ্গে সঙ্গে তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকার কারণে শিশুটিকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। এ সময় একটু একটু করে অক্সিজেনের ঘাটতি হচ্ছিল, তাতে শিশুটির মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা ছিল। তবে শিশু বিভাগের চিকিৎসকেরা প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হন যে অক্সিজেনের প্রবাহ বিঘ্নিত হওয়ার ফলে শিশুটির স্নায়বিক কোনো সমস্যা ঘটেনি। সে পুরোপুরি সুস্থ আছে।

যন্ত্রণাক্লিষ্ট শিশুটি যখন আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়, তখন সে প্রায় নিঃসাড়। সঙ্গে আত্মীয়স্বজন অনেকেই ছিলেন। চোখের সামনে ছোট্ট শিশুর এমন কষ্ট তাঁরা সহ্য করতে পারছিলেন না। একেবারে দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন। বিপদ কেটে যাওয়ার পর তাঁদের চোখেমুখে ছিল কৃতজ্ঞতার ঝিলিক। চিকিৎসক হিসেবে আমার জন্য এটি একেবারেই অন্য রকম এক অভিজ্ঞতা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক এবং নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের নিরবচ্ছিন্ন কর্মতৎপরতায় নিত্যদিন এমন বহু প্রাণ বেঁচে যায়। নাক, কান, গলা ও হেড, নেক সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. শেখ নুরুল ফাত্তাহ রুমির নেতৃত্বে যে সেবা অব্যাহত রয়েছে, ভবিষ্যতেও মানুষের বিপদে এভাবে সেবা দেওয়ার মানসিকতা নিয়েই কাজ করতে চাই।