তুমি কি তোমাকে চাকরি দেবে?

এ বছরই যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির বিহেভিয়রাল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের মালবিকা সরকার। তিনি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের সহযোগী ডিন ছিলেন। শিক্ষকতা ও গবেষণা করছেন দীর্ঘদিন। ২০১৮ সালে পেয়েছিলেন ‘হিরোইন অব হেলথ’ স্বীকৃতি। সম্প্রতি দেশে এসেছিলেন এই গবেষক ও বিজ্ঞানী। ২৬ নভেম্বর তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. সাইফুল্লাহ

প্রথম আলো:

ব্রাউন ইউনিভার্সিটিতে আপনার ব্যস্ততা এখন কী নিয়ে?

এখানে আমার মূল কাজ শিক্ষকতা। দুটি কোর্সের পাঠ্যক্রম আমাকে সাজাতে হয়েছে। এ ছাড়া নানা রকম দায়িত্ব আছে। যেমন শিক্ষার্থীদের মেন্টরিং করা, পোস্টার প্রেজেন্টেশনের মূল্যায়ন, পিএইচডি শিক্ষার্থীদের তত্ত্বাবধান। পাশাপাশি দুটি নতুন গবেষণার প্রস্তাবনা লিখছি।

প্রথম আলো:

জনস্বাস্থ্যে আপনার কাজের ক্ষেত্র মূলত কী?

বিশেষজ্ঞ বলব না, আমি অভিজ্ঞ ‘ইমপ্লিমেন্টেশন রিসার্চ’-এ। অর্থাৎ কোনো রোগ নিয়ন্ত্রণের কর্মসূচি ঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, সেটা দেখাই আমার কাজ। যেমন ধরুন কোভিডের সময় কমিউনিটিকে কাজে লাগিয়ে মাস্ক বিতরণ, তথ্য সংগ্রহ, কোভিড পরীক্ষাসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছিল ব্র্যাক। এই কাজগুলো যেভাবে করার কথা, সেভাবে হচ্ছে কি না, না হলে কেন হচ্ছে না, কোথায় কী সমস্যা, সমাধান কী হতে পারে—এসব ছিল আমার কাজের বিষয়। ইমপ্লিমেন্টেশন রিসার্চ খুবই সম্ভাবনাময় একটা বিষয়। সে জন্যই ব্রাউন এমন কাউকে খুঁজছিল, যার এ–সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা আছে। আমাকে নেওয়ার এটা একটা বড় কারণ। ওদের শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া কিন্তু বেশ লম্বা। এক সপ্তাহ ধরে প্রায় ৩০ জন অধ্যাপকের কাছে সাক্ষাৎকার দিতে হয়েছে।

প্রথম আলো:

আপনি ব্র্যাকের কাজের জন্য চট্টগ্রাম থেকে চলে গেছেন দিনাজপুর। আবার পড়ালেখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব হাইডেলবার্গে গেছেন। এমনকি পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বুরকিনা ফাসোতেও কাজ করেছেন। আপনার মধ্যে কি নতুন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার একরকমের ঝোঁক আছে?

ব্যক্তিগতভাবে আমি সব সময় আত্মোন্নয়নের পথ খুঁজি। যদি মনে হয় আমার কোনো উন্নতি হচ্ছে না, এক জায়গায় আটকে আছি, তখনই একধরনের ক্লান্তি পেয়ে বসে। ডিসেম্বরে আমার বয়স ৬০ হবে। অনেকে বলে, যে বয়সে মানুষ অবসরের কথা ভাবে, সেই বয়সে তুমি এই নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে গেলে কেন? ব্রাউনে এসে যে নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে কাজ করছি, আগ বাড়িয়ে বলতে পারছি যে আমি এটা করতে চাই-ওটা করতে চাই, এখানেই তো আনন্দ। নতুন কিছু করলে নিজের সক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়। আমি যদি পরীক্ষা দিই, তাহলে যত ক্ষীণই হোক, পাস করার সম্ভাবনা থাকবে। কিন্তু যদি পরীক্ষা না-ই দিই, তাহলে তো নিশ্চিত ফেল!

প্রথম আলো:

জনস্বাস্থ্য পেশায় না এসে চিকিৎসক হলেই ভালো হতো—এ রকম কি কখনো মনে হয়েছে?

একদমই না। আমি তো আসলে চিকিৎসক হতে চাইনি। ইচ্ছা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব। ১৭ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। একরকম পরিবারের চাপেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই। জনস্বাস্থ্য পেশার সুবাদে আমি পৃথিবীর নানা প্রান্তে গেছি, অনেক ধরনের মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। আমি মনে করি, এটা আমাকে আরও ভালো মানুষ করেছে। তা ছাড়া বিনে পয়সায় সারা পৃথিবী ঘুরছি, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে! (হাসি)

প্রথম আলো:

আপনার কি মনে হয়, কোভিড–পরবর্তী সময়ে পড়া কিংবা গবেষণার বিষয় হিসেবে জনস্বাস্থ্যের গুরুত্বটা মানুষ আরও বেশি বুঝতে পেরেছে?

নিশ্চয়ই। আরও একটা বিষয় মানুষ জেনেছে। তা হলো জীবনযাপনের ধরন, অভ্যাস, এগুলো কত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সত্য বের হয়ে এসেছে। যেমন টাকা থাকলেই যে আপনি ভালো চিকিৎসা পাবেন, তা নয়। তবে অন্য অনেক দেশের তুলনায় জনস্বাস্থ্যে বাংলাদেশ কিন্তু ভালো করছে। শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যুর হার, এমনকি কোভিড নিয়ন্ত্রণেও বাংলাদেশের অবস্থান বেশ ভালো। সাধারণ মানুষকে কাজে লাগিয়ে আমাদের দেশে যত কর্মসূচি হয়েছে বা হচ্ছে, অন্য অনেক দেশ সেটা ভাবতেই পারে না। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে আমি যখন পড়িয়েছি, দেখেছি শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশেরই মাঠপর্যায়ে জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। ব্রাউনের শিক্ষার্থীদের কিন্তু সেটা নেই।

মালবিকা সরকার
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
প্রথম আলো:

আপনি অনেকগুলো গবেষণায় যুক্ত ছিলেন। কোন গবেষণাটি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন?

এখন পর্যন্ত প্রায় ১৩৬টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছি। কিন্তু এটা ঠিক যে সরাসরি মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলেছে, এমন গবেষণার সংখ্যা খুব বেশি না। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য মাতৃসেবা নিয়ে একটা কাজ করেছি, সেটার ভিত্তিতে বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। বাল্যবিবাহ, কোভিড, শিশুদের যক্ষ্মা নিয়েও আমার বেশ কিছু কাজ আছে।

প্রথম আলো:

যাঁরা জনস্বাস্থ্য পেশায় আসতে চান, তাঁদের কী পরামর্শ দেবেন?

জনস্বাস্থ্য নিয়ে একটা ভুল ধারণা আছে। সবাই ভাবে এটা কেবল চিকিৎসকেরাই পড়বেন। তা কিন্তু নয়। বাংলা, ভূগোল, অর্থনীতি, যেকোনো বিষয় পড়ে আপনি জনস্বাস্থ্য পেশায় আসতে পারেন। শুধু গণিতের ভিতটা একটু শক্ত থাকলে ভালো হয়।

প্রথম আলো:

যত দূর জানি, আপনি ছোটবেলা থেকে প্রচুর বই পড়েন। নানা ধরনের সিনেমা, হাল আমলের ওয়েব সিরিজ, এসবের প্রতিও আপনার খুব আগ্রহ। এই চর্চা কি পেশাদার জীবনেও সাহায্য করেছে?

নিশ্চয়ই। গবেষণা করতে হলে কিন্তু মাঠপর্যায়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়। বই পড়া, সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা আমার যোগাযোগের দক্ষতা আরও সমৃদ্ধ করেছে। আমি অমর্ত্য সেনের দ্য আইডিয়া অব জাস্টিস পড়ি, আবার ‘টিনটিন’ও পড়ি। বার্বি দেখি, ওপেনহাইমারও দেখি। টিচিং ইজ আ পারফরম্যান্স (শিক্ষকতা একধরনের পরিবেশনা)। এখন ছেলেমেয়েদের মনোযোগের দৈর্ঘ্য ৪৫ সেকেন্ড। আমি যদি ওদের মন বুঝতে না পারি, তাহলে তো ভালো পারফর্ম করতে পারব না।

প্রথম আলো:

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের কোন দিকটায় উন্নতি করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?

আমাদের কিছু কিছু সফট স্কিলের (জীবনমুখী দক্ষতা) অভাব আছে। যেমন একটা কাজ গুছিয়ে করা, সময় ব্যবস্থাপনা। আপনি যদি একটা কিছু না বোঝেন, প্রশ্ন করেন, তাহলে কিন্তু আপনার শিক্ষক বা সুপারভাইজার খুশি হবেন। কিন্তু আমি যে জানি না, এটা আমরা অন্যকে বুঝতে দিতে চাই না। আমি আমার শিক্ষার্থীদের বলি, ‘তুমি যদি একবার বলো যে “জানি না”, তাহলে একবার বোকা হবে। কিন্তু যদি না জেনেও জানার ভান করো, তাহলে সারা জীবন বোকা থাকবে।’ এই যে আমাদের দেশের এত বড় বড় চাকরি ভারতীয়, শ্রীলঙ্কানরা নিয়ে যাচ্ছে, এটা কিন্তু এ কারণে নয় যে আমাদের কারিগরি দক্ষতা নেই। বরং কিছু সফট স্কিলের অভাবে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। আমি আমার শিক্ষার্থীদের বলি, ‘ভেবে দেখো, তুমি যদি একজন চাকরিদাতা হও, তুমি কি তোমাকে চাকরি দেবে? তুমি যদি তোমাকে চাকরির যোগ্য মনে না করো, তাহলে অন্য কেউ কেন করবে?’