২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

‘পেয়েছি মনের মতো লোক’

১৯৫২ সালে চীন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরে যা বাংলা একাডেমি থেকে আমার দেখা নয়াচীন নামে প্রকাশিত হয়েছে। আজ তাঁর জন্মদিনে বইটি থেকে একটি অংশ প্রকাশিত হলো তরুণ পাঠকদের জন্য।

শেখ মুজিবুর রহমান
ছবি: নাসির আলী মামুন,১৯৭২, ফটোজিয়াম

নানকিং শহর নদীর পাড়ে। এখানে জাহাজে করে প্যাসেঞ্জার ট্রেন পার করা হয়। নামতে হয় না প্যাসেঞ্জারদের। ট্রেনটা এপার থেকে জাহাজে ওপারে চলে যায় আমরা দেখতে পেলাম। পীর সাহেব (পীর মানকী শরীফ। পুরো নাম পীর আমিনুল হাসনাত। তিনি ছিলেন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের একজন প্রগতিশীল ধর্মীয় নেতা। ১৯৪৫ সালে মুসলিম লীগে যোগ দেন।—বি. স.) ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইরা নদীর পাড়, বিরাট নদী, নদীর পাড়ে কারখানা, নদীর ঢেউ দেখতে ভালোবাসে। কারণ পাঞ্জাব ও সীমান্তের ভাইদের কপালে এ সমস্ত কম জোটে। আমরা পূর্ব বাংলার লোক নদীর পাড়ে যাদের ঘর, নদীর সাথে যাদের বন্ধুত্ব, ঢেউয়ের সাথে যাদের কোলাকুলি, তারা কি দেখতে ভালোবাসে এগুলি? তাই পীরসাহেবকে বললাম, চলুন, বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে যাই। খাবার সময় প্রায় হয়ে এলো। আমরা হোটেলে ফিরে এসে খেলাম, তারপর আবার বেরিয়ে পড়লাম নানকিং বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে।

বিশ্ববিদ্যালয় তখন বন্ধ ছিল। ভাইস-চ্যান্সেলর ও কয়েকজন প্রফেসর এবং কিছু ছাত্র–যারা খোঁজ পেয়েছিল, উপস্থিত হয়েছিল। খাওয়ার জোগাড়ও করেছিল খুব। আমরা ক্লাসরুম দেখলাম, বিজ্ঞান শাখা দেখলাম, বিদেশি এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট দেখলাম। আমাদের একটা হলে নিয়ে যাওয়া হলো।

সেখানে ফুল-ফলে টেবিলটা বোঝাই। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আমাদের বক্তৃতায় ধন্যবাদ দিলেন এবং বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংখ্যা কত, প্রফেসর কত, সরকার কীভাবে সাহায্য করছে, কয়টা নতুন ডিপার্টমেন্ট খোলার জন্য দালান করা হতেছে ইত্যাদি। আমরা ‘দয়া করে’ এসেছি সেজন্য যথেষ্ট কৃতার্থ হয়েছেন। পাকিস্তান ও চীন পাশাপাশি দাঁড়াইয়া শান্তি প্রতিষ্ঠিত করুক। দুনিয়ায় শান্তি কায়েম হউক ইত্যাদি অনেক কিছু বললেন।

আমাদের দলনেতা পীরসাহেব বক্তৃতা করলেন : “আমরা পাকিস্তানি, ইসলাম ধর্মে অধিকাংশ লোক বিশ্বাসী, ইসলাম অর্থ শান্তি, আমরাও চাই দুনিয়ায় শান্তি কায়েম হউক। অত্যাচার, অবিচার দুনিয়া থেকে মুছে যাক। আমরা যে স্নেহ ও ভালোবাসা আপনাদের কাছ থেকে পেলাম তা কখনও ভুলবো না। যে কষ্ট করে আপনারা আমাদের সকল কিছু দেখালেন, সে জন্য আমি আমার ডেলিগেটদের পক্ষ থেকে আপনাদের অশেষ ধন্যবাদ জানাই। পাক-চীন বন্ধুত্ব কায়েম থাকুক।” পীর সাহেব উর্দুতে বললেন, সীমান্ত আওয়ামী লীগের সম্পাদক ফজলুল হক সায়েদা, যিনি তা ইংরেজি করে দিলেন।

ভাইস চ্যান্সেলর চীনা ভাষায় বললেন, দোভাষী ইংরেজি করে দিলেন। এখানেই আমি দেখলাম যে, দোভাষী যখন ২/১ জায়গায় ভালোভাবে ইংরেজি করতে পারছে না, সেখানে ভাইস চ্যান্সেলর নিজেই ওকে ইংরেজি করে দিচ্ছে। ভদ্রলোক ভালো ইংরেজি জেনেও ইংরেজি বলেন না। জাতীয় ভাষায় কথা বলেন। আমরা বাঙালি হয়ে ইংরেজি আর উর্দু বলার জন্য পাগল হয়ে যাই। বলতে না পারলেও এদিক ওদিক করে বলি।

আমরা যখন ইউনিভার্সিটি দেখা শেষ করে বিদায় নিলাম, রাস্তার বড় ছেলেমেয়ে, ছোট ছোট ছেলেমেয়ে–প্রায় সকলেই ছাত্র, আমাদের ‘হোপিন ওয়ানশোয়ে’ বলে বিদায় সংবর্ধনা জানালো। আমরা ‘দুনিয়ায় শান্তি কায়েম হউক’ বলে বিদায়ের উদ্যোগ নিতেই, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আমাকে জড়িয়ে ধরলো। কারণ, ওদের আমি একটু ঠাট্টা করেছিলাম, মুখ ভেঙচিয়া দিয়াছিলাম। ওরা মনে করলো, ‘পেয়েছি মনের মতো লোক’। তাই আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি ওদের সাথে কিছু খেলা করে রওয়ানা হলাম। আমার বন্ধু-বান্ধবরা আগেই গাড়িতে উঠে বসে রয়েছে। মনে মনে বিরক্ত হলো বলে আমার মনে হলো। কিন্তু কী করবো? ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আনন্দময় সঙ্গ যেন হুট কর ছেড়ে আসা যায় না, আর আমার স্বভাবও সে রকম না। ছেলেমেয়েদের সাথে মিশতে আমি ভালোবাসি।

(বইয়ে প্রকাশিত বানানই অনুসরণ করা হলো)