স্বপ্ন ছোঁয়ার মিশনে একদল তরুণ
২০১৮ সালে হাড়কাঁপানো এক শীতের রাতে মুঠোফোনে একটা খুদে বার্তা পান মুহতাসিম আবশাদ। এক ছোট বোন লিখেছে, ‘রংপুর সুপার মার্কেটের সামনে অসুস্থ অসহায় এক মহিলা পড়ে আছেন। আমরা কি কোনোভাবে তাঁকে সাহায্য করতে পারি?’
তখন বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির হয়ে কাজ করতেন মুহতাসিম। কলেজ পর্যায়েও ক্লাব কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতাকে সঙ্গী করে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে অসুস্থ ও স্বামী-সন্তানহীন করিমন বেগমকে সাহায্য করতে এগিয়ে যান মুহতাসিম। একজন দাতা সদস্যের সহায়তায় তাঁর নিরাপদ থাকার জায়গা ও মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু করিমন তো একা নন। তাঁর মতো আরও অনেকেরই নিশ্চয় সাহায্য প্রয়োজন। তাঁদের জন্যও তো কিছু করা দরকার।
এই তাড়না থেকেই জন্ম নেয় ‘চলো স্বপ্ন ছুঁই’। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা মুহতাসিম আবশাদ পড়ছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরিবেশ বিজ্ঞানের তৃতীয় বর্ষে। ৩০ সদস্য নিয়ে শুরু করা সংগঠনটির বর্তমান সদস্য চার শর বেশি। রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের প্রায় সাতটি জেলায় তাঁরা কাজ করেন।
নানা কার্যক্রম
সংগঠনের অনেক কার্যক্রম। যেমন ‘জিরো হাঙ্গার প্রজেক্ট’–এর আওতায় তারা গরিব মানুষকে খাবার দিয়ে সহায়তা করে। গত দুই ঈদে বসেছিল ১০ টাকার বাজার। মাত্র ১০ টাকা শুভেচ্ছামূল্যে নিম্ন আয়ের মানুষেরা কিনতে পেরেছেন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। এক টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে গরুর মাংস। এ ছাড়া পুরো রমজান মাসজুড়ে বিতরণ করা হয়েছে ইফতারি৷ সংগঠনের আরেক প্রকল্প ‘অপরাজিতা’। এই প্রকল্পের আওতায় ২০২১ সালে রংপুর শহরের রেস্টুরেন্টে স্যানিটারি ন্যাপকিন বক্স স্থাপনের উদ্যোগ নেয় তারা। উদ্যোগটি এখনো চালু আছে। মেয়েদের ঋতুকালীন স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে শহরের বিভিন্ন স্কুলে ক্যাম্পেইন করার পাশাপাশি প্রান্তিক অঞ্চলে উঠান বৈঠকের আয়োজন করে এই সংগঠন। এমনিভাবে দরিদ্র মানুষকে স্বাবলম্বী করা, প্লাস্টিক দূষণ রোধসহ নানা ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে ‘চলো স্বপ্ন ছুঁই’। জাতিসংঘের নির্ধারিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) পাঁচটি লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে তারা।
জন তহবিল (ক্রাউড ফান্ডিং) গঠনের মাধ্যমেই মূলত এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করে তারা। চলো স্বপ্ন ছুঁইয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা, বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তানজিম আলম বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে নিয়মিত কাজ করার কারণে রংপুরে অনেকে আমাদের চেনেন। অনেকেই তাঁদের জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকীসহ বিভিন্ন বিশেষ দিনে অনুদান দেন, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে চান। সবার সহযোগিতাতেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।’
স্বাবলম্বী করার স্বপ্ন
প্রায় ৫ বছরের পথ চলায় এ পর্যন্ত প্রায় ১৪৫টি পরিবারকে স্বাবলম্বী করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন মুহতাসিমরা। এই তরুণদের হাত ধরে যাঁদের জীবন বদলেছে, তাঁদের একজন লতা বেগম। দুই বছর আগে এই সংগঠন থেকে সেলাই মেশিন পান তিনি। মুঠোফোনে বলছিলেন, ‘আমার স্বামী অটোরিকশা চালায়। আগে টাকাপয়সা নিয়ে সমস্যা হতো। এখন সেলাই মেশিন চালিয়ে একটা ভালো টাকা আয় করি। বাচ্চাদের লেখাপড়ায় সাহায্য হয়। আমার যে গরু ছাগল আছে, ওগুলো লালন–পালনেও এই টাকা কাজে লাগাই।’
লতা বেগমের মতো মানুষদের তাঁরা কীভাবে খুঁজে বের করেন? মুহতাসিম বুঝিয়ে বলেন, ‘কখনো কখনো স্বেচ্ছাসেবকেরা খবর দেন। আমাদের কারও কাছে এ রকম কোনো মানুষের খবর এলে আমরা নিজেরাও গিয়ে আগে যাচাই করি। এরপর তাঁর সঙ্গে আলোচনা করি, কী রকম সাহায্য পেলে তিনি স্বাবলম্বী হতে পারবেন। কেউ হয়তো পানের দোকান ভালো পরিচালনা করতে পারেন, তাঁকে আমরা পানের দোকান করে দেওয়ার চেষ্টা করি। কোনো নারীর হয়তো হাঁসমুরগি পালনের জায়গা আছে, তাঁকে সেটাই দেওয়ার চেষ্টা করি।’
একদিন আর কারও খাবারের কষ্ট থাকবে না, সবাই হবে শিক্ষিত, এমন এক স্বপ্ন নিয়েই কাজ করে যাচ্ছে এই তরুণ দল।